১০ বছরে দেশের বিদু্যৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে প্রায় ৩ গুণ হয়েছে। সে হারে চাহিদা তৈরি না হওয়ায় সারা বছরই বিদু্যৎ কেন্দ্রগুলোর বড় একটি অংশের উৎপাদন বন্ধ থাকে। শীত মৌসুমে এই সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় অর্ধেকেরও বেশি। এদিকে চলতি বছরে নতুন আরও কয়েকটি বিদু্যৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসায় বসে থাকা কেন্দ্রের সংখ্যা আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশ বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যানুযায়ী চলতি বছরের শেষের দিকে বেসরকারি খাতে নতুন বেশ কয়েকটি বিদু্যৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আশায় বর্তমান সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াটে। কিন্তু চাহিদা রয়েছে আগের মতোই। ফলে গত বছরের তুলনায় এবার শীতে বন্ধ থাকা কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০২৩ সালের শুরুতে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে দেশের মোট বিদু্যৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট। এছাড়া আমদানি বিদু্যতের পরিমাণ আরও প্রায় ১ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু মে থেকে অক্টোবর এ সময়ে দেশে বিদু্যতের সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে প্রায় ১৪ হাজার মেগাওয়াট এবং গড় চাহিদা ১২ হাজার মেগাওয়াট। আর শীতের ৪ মাসসহ বাকি ৬ মাসে সর্বোচ্চ চাহিদা ১১ হাজার এবং গড় চাহিদা ১০ হাজার মেগাওয়াট।
ফলে গ্রীষ্মে প্রায় ১১ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদু্যৎ কেন্দ্রের উৎপাদন নিয়মিত বন্ধ থাকে। যা এবার শীতে আরও বেড়ে ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিপিডিবির তথ্যানুযায়ী, ৭ ডিসেম্বর দেশে বিদু্যতের চাহিদা ছিল ৮৯০০ মেগাওয়াট, আগের দিন চাহিদা ছিল ৯১৫৩ মেগাওয়াট। কিন্তু উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট। সে হিসাবে তিন ভাগের দু'ভাগ কেন্দ্রই
চাহিদা না থাকায় বন্ধ রাখতে হয়েছে। ফলে গত শীতে তুলনায় এবার ক্যাপাসিটি চার্জ আরও ২০ শাতংশ বাড়বে। সে হিসেবে ৭০ শতাংশ কেন্দ্রকে এবার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে বিপিডিবিকে।
এদিকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেবল বেসরকারি খাতের বিদু্যৎ কেন্দ্রগুলোর পাওনা ছাড়িয়েছে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার যা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এই বকেয়া পরিশোধে হিমসিম খেতে হচ্ছে বিদু্যৎ উৎপাদন, বিতরণ ও উন্নয়নের কাজ করা একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিপিডিবিকে।
এ বছর জুনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশ বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ২০১৭-১৮ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বেসরকারি বিদু্যৎ কেন্দ্রগুলোকে দিয়েছে ৫৭ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। এছাড়াও এই ৫ বছরে বেসরকারি বিদু্যৎ কেন্দ্রগুলোকে দেওয়া ক্যাপাসিটি চার্জের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর 'ফিক্সড কস্ট' যোগ করলে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৯৯ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা, অর্থাৎ বিদু্যৎ উৎপাদন বন্ধ থাকলেও সরকারকে এই অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে।
এ বছর জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়া বিদু্যৎ কেন্দ্রগুলো হলো, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রম্নপের ১ হাজার ২২৪ মেগাওয়াট, মেঘনাঘাটের রিলায়েন্স পাওয়ারে এলএনজিভিত্তিক ৭১৮ মেগাওয়াট বিদু্যৎ কেন্দ্র, এলএনজিভিত্তিক ৫৯০ মেগাওয়াটের জিই-সামিট মেঘনাঘাট-২ এবং মেঘনাঘাটে এলএনজিভিত্তিক ৫৮৪ মেগাওয়াট ইউনিক পের বিদু্যৎ কেন্দ্র। এছাড়াও রয়েছে আদানি গ্রম্নপের ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট কয়লাচালিত বিদু্যৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট এবং রামপাল পাওয়ার পস্নান্টের দ্বিতীয় ইউনিট। এর বাইরে আরও বেশ কয়েকটি কেন্দ্র উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হলেও সরকার গ্যাস সরবরাহ করতে না পারায় তা উৎপাদনে যেতে পারছে না।
এদিকে বিদু্যৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে ৩ গুণ হলেও চলতি বছরে লোডশেডিং করতে হয়েছে দেশব্যাপী। মূলত জ্বালানি না থাকায়। সেপ্টেম্বরে পায়রা ও রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদু্যৎ কেন্দ্র দুটি বন্ধ থাকায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়। ডলার সংকটে কয়লা আমদানি ও আগের বিল পরিশোধ না করায় বিদেশি প্রতিষ্ঠান সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক আংশিক বকেয়াসহ নতুন কয়লা আমদানিতে অর্থছাড় করলে অক্টোবরে কেন্দ্র দু'টো ফের উৎপাদন শুরু করে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারকে এসব বিদু্যৎ কেন্দ্র চুক্তি অনুযায়ী উৎপাদন না করলেও ডলারে ক্যাপাসিটি চার্জ, জ্বালানির জোগান ও বিতরণ করা বিদু্যৎ বিল টাকায় নিয়ে ডলারে পেমেন্ট করতে হয়। যা বিপিডিবি'র সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুলস্না মনে করেন, সরকারকে এই নীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে অথবা সংশোধন করতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমান ডলারের সংকট ও বাড়তি দাম আমদানি নির্ভর জ্বালানি খাতে সরকারের ব্যয় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বসিয়ে বসিয়ে বেসরকারি খাতে এত বিপুল অর্থব্যয় ভোক্তার উপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে। কিন্তু সরকার আগের চুক্তিতেই বিদু্যৎ কেন্দ্রর সংখ্যা বাড়িয়ে চলছে।
২০২৩-২৪ অর্থ-বছরের বিদু্যৎ খাতে নতুন আরও প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষতা বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা উলেস্নখ করে এই বিশ্লেষক বলেন, যদি সক্ষমতা বাড়াতেই হয় তাহলে চুক্তি পরিবর্তন করা উচিত। সে ক্ষেত্রে বিদু্যৎ কেন্দ্রের জ্বালানি সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র প্রয়োজনে সরকারের মাধ্যমে আমদানি করবে এমন পদ্ধতি করা উচিত।