শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২
চকবাজারের ইফতার

হাতের নাগালে থাকলেও পকেটের নাগালে নেই

যাযাদি ডেস্ক
  ১৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
হাতের নাগালে থাকলেও পকেটের নাগালে নেই
হাতের নাগালে থাকলেও পকেটের নাগালে নেই

পবিত্র রমজান মাসের প্রথম ইফতারকে কেন্দ্র করে উৎসবের আমেজ তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী চকবাজারে। বরাবরের মতো বাহারি সব খাবার, শরবত আর হাঁক-ডাকে পুরো এলাকা ছিল সরগরম। নানা স্বাদের ইফতার কিনতে দূরদূরান্ত থেকে অনেকে ছুটে আসেন এখানে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব পড়েছে এবার এখানকার মুখরোচক সব খাবারে, ফলে অনেকেই পকেটের 'স্বাস্থ্যের' কথা ভেবে রসনায় লাগাম পরাতে বাধ্য হচ্ছেন।

গতবছরের তুলনায় এবছর চকবাজারে ইফতার সামগ্রীর দাম বেশি বলছেন ক্রেতারা; বিক্রেতারাও তা অস্বীকার করেননি। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা কাঁচামালের চড়া দামকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, গত বছর যে দামে তারা ইফতারের মালামাল কিনেছেন তার তুলনায় এ বছর গুণতে হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি টাকা।

স্থানীয়রা বলেন, রোজায় ইফতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষঙ্গ। ইফতারের খাবার সামগ্রী বিক্রির জন্য বহুল পরিচিত নাম ঢাকার চকবাজার। বহু বছরের ঐতিহ্য আর খাবারের ভিন্ন স্বাদের কারণে পুরান ঢাকার এই খানদানি ইফতারের সুনাম ছড়িয়ে আছে সারা দেশে। চকবাজারে মুখরোচক নানা খাবার নিয়ে বসেন বিক্রেতারা। পছন্দ আর সামর্থ্য অনুযায়ী কেনেন ক্রেতারা।

মঙ্গলবার দুপুর ২টা

থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত চকবাজারের কয়েকটি ইফতারের দোকান ঘুরে জানা গেল, চড়া দামের কথা। ছোলা-বুট, পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, ঘুঘনি, নিমকি, জিলাপি, শাহী জিলাপি, রেশমি জিলাপি, জালি কাবাব, সুতি কাবাব, টিক্কা কাবাব, মোরগ পোলাও, পরোটা, কাটলেট, ডিম চপ, কাচ্চি বিরিয়ানি, তেহারি, গরু-খাসির হালিম, দইবড়া, পনির, কিমা পরোটা, খাসির লেগ রোস্ট, মুরগি-হাঁস-কবুতর-কোয়েলের ফ্রাইসহ বহুরকমের খাবারে ভরপুর ছিল পুরো চকবাজার।

মিষ্টান্ন ও পানীয়ের মধ্যে ছিল রসমালাই, দধি, ছানার মিষ্টি, ফালুদা, ফিরনি, লাবাং, লেবুর শরবত, তোকমার শরবত, লাচ্ছি, নুরানি লাচ্ছি, ছানামাঠা, মাঠা ও পেস্তা বাদামের শরবতসহ বিভিন্ন আইটেম।

বাহারি সব ইফতার হাতের নাগালে থাকলেও পকেটের নাগালে নাই বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন চকবাজারের ফল দোকানি সাজ্জাদুল ইসলাম।

তিনি বলেন, 'সারাদিন ফল বিক্রি করে লাভ করি সাত-আটশ টাকা। বাড়িতে বউ-বাচ্চার জন্য টাকা পাঠামু নাকি নিজে এসব খাবার দিয়ে ইফতার করমু? এগুলা আসলে আমাদের জন্য না, এসব আয়োজন বড়লোকদের জন্য। আমরা গরিবরা তো মুড়ি, পেঁয়াজু, শরবত এসব দিয়ে ইফতার করি।'

চকবাজারের কয়েকটি ইফতার দোকান ঘুরে দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় মাংসের পদগুলোয় দাম বেড়েছে প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ।

বিক্রেতারা বলছেন, পাকিস্তানি মুরগির আস্ত রোস্ট আকার ভেদে প্রতিটি ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এবার। গত বছর যার দাম ছিল ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।

কোয়েল পাখির আস্ত রোস্ট বিক্রি করছেন ১০০ থেকে ১২০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকা। এবার খাসির মাংসের একেকটি টুকরো ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা হয়েছে।

বিভিন্ন রকমের মাংসের তৈরি ইফতারের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ইমরান তালুকদার।

তিনি বলেন, 'বাজারে তেল, পেঁয়াজ, মসলা, মাংস ছাড়াও অন্য জিনিসপত্রের যে দাম, সে তুলনায় আমরা খুবই কম দাম রাখছি। প্রতিবছরের সঙ্গে সমন্বয় করেই এ বছর প্রতিটা পদের দাম রেখেছি। আসলে এর চেয়ে কম দাম রাখলে আমাদের ক্ষতি হবে।

পেঁয়াজু, চপ বা বেগুনি প্রতিটির দাম ৫ টাকা করে হলেও ছোট হয়েছে আকার।

পূর্বের দামে কিভাবে বিক্রি করছেন জানতে চাইলে দোকানি আবুল হাশিম বলেন, 'গত বছরের চেয়ে এবার জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেলেও আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত রোজাদারদের কথা মাথায় রেখে আগের দামেই বিক্রি করছি। ডিম চপ ৪০ টাকা রাখলেও বাকি আইটেমগুলো ৫ টাকা করেই রাখছি।'

চকবাজারের ইফতার অন্য খাবারগুলোর মধ্যে জালি কাবাব ৩০ টাকা, টানা পরোটা ৫০ টাকা, কিমা পরোটা ৭০ টাকা, কাঠি কাবাব ৪০ (একটি) টাকা, ডিম চপ ৫০ টাকা, দইবড়া ১০০ টাকা (৩টি), ফালুদা কেজি ২২০ টাকা, পেস্তা বাদাম শরবত ২৫০ টাকা লিটার, মুরগির ললিপপ ৪০ টাকা, চিকেন ফিংগার ৪০ টাকা, চিকেন স্যান্ডুইচ ৫০ টাকা, চিকেন স্প্রিং রোল ৪০ টাকা, ভেজিটেবল রোল ৩০ টাকা, চিকেন রোল প্যাটিস ৪০ টাকা, চিকেন প্যাটিস ৫০ টাকা, চিকেন শর্মা ৭০ টাকা, চিকেন ললিপপ ৪০ টাকা, চিকেন রেশমি কাবাব ৫০ টাকা, মিনি পিজ্জা ৭০ টাকা, চিকেন টিক্কা ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এ ছাড়া প্রতিটি মুরগির রুটি ৬০ টাকা, গরুর রুটি ৮০ টাকা এবং খাসির রুটি ১০০ টাকায় বিকোচ্ছে।///////////

ইসলামপুরের স্থায়ী বাসিন্দা রহমান তালুকদার ইফতার কিনতে প্রতিবছরের মতো এবারও এসেছেন চকবাজারে। ইফতারের মূল উপাদানের পাশাপাশি তিনি নিয়েছেন মাংসের কয়েকটি আইটেম, দই বড়া আর ফিরনি।

তিনি বলেন, "এবার ইফতার আইটেমগুলোর দাম অন্যান্য বছরের তুলনায় একটু বেশি মনে হয়েছে। তাই বেশিকিছু কিনি নাই। বাসায় স্ত্রী আর মেয়ে মিলে ইফতার তৈরি করেছে। তারপরও এখান থেকে কিছু না কিনলে কমতি থেকে যাচ্ছে বলে মনে হয়। তাই আমাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এসেছি।"

সোহাগ নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে পুরান ঢাকার চকবাজারে শাহি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন মোগল সুবেদার শায়েস্তা খান। পরে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ ১৭০২ সালে চকবাজারকে একটি আধুনিক বাজারে রূপ দেন। তখন থেকে প্রতি রমজানে এখানে মুখরোচক ইফতারির বাজারের প্রচলন শুরু হয়। এটি এখন পর্যন্ত চলছে। অনেকে বংশপরম্পরা এখানে ব্যবসা করছেন। এটা অনেক দিনের ঐতিহ্য।

চকবাজারে ইফতার কিনতে আসা জহিরুল ইসলাম বলেন, আমি ছাত্র জীবনে পুরান ঢাকায় থাকতাম। তখন থেকেই এখানকার ইফতার আয়োজন আমার কাছে খুব ভালো লাগত। প্রতি রোজায় এখানে আসি। অনেক ঐতিহ্যবাহী খাবার পাওয়া যায়। দেখতেও অনেক ভালো লাগে। সবার মধ্যেই একটা উৎসবের আমেজ কাজ করে। তবে গত বছরের তুলনায় এবার দাম অনেক বেশি। মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তের পক্ষে এখান থেকে খুব বেশি ইফতার কেনার সুযোগ নেই।

অবশ্য বাড়তি দামের বিষয়টি মানতে নারাজ বিক্রেতারা। তারা বলছেন, বাজারে সবকিছুর দাম এমনিতেই বেশি। ইফতারেও এর প্রভাব পড়েছে।

নজরুল ইসলাম নামে এক বিক্রেতা বলেন, বাজারে প্রতিটি জিনিসের দামি বেশি, এটা তো সবাই জানেন। আমরা খাসির কাবাব ও গরুর কাবাব কেজি হিসেবে বিক্রি করছি, যা এক থেকে দেড় হাজারের মধ্যে রয়েছে। আর খাসির রানের রোস্ট, মুরগির রোস্ট ও কবুতরের রোস্ট পিস হিসেবে বিক্রি করছি। আকার ও মানভেদে এগুলোর দাম নির্ভর করে। এছাড়া চিকন জিলাপি, বড় শাহি জিলাপি, দইবড়া, চিকেন স্টিক পিস, জালি কাবাব, বিফ স্টিক, কিমা পরোটা ও টানা পরোটা গতবারের দামের কাছাকাছি রয়েছে।

চকবাজারের পাশাপাশি পুরান ঢাকার বাংলাবাজার, সদরঘাট, নবাবপুর, বংশাল, সিদ্দিকবাজার, গুলিস্তান, ওয়ারী, লক্ষ্‌মীবাজার, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, আরমানিটোলা, সুরিটোলা, কাপ্তানবাজার, চানখাঁর পুল, আজিমপুর, টিপু সুলতান রোড ও ধোলাইখালসহ বিভিন্ন এলাকায় কিংবা পাড়া-মহলস্নায়ও বিক্রি হয়েছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী নানা ইফতার সামগ্রী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে