সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

সগিরা হত্যার ৩৫ বছর পর দু'জনের যাবজ্জীবন

যাযাদি রিপোর্ট
  ১৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
বুধবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে রাজধানীর আলোচিত সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা শেষে যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি আনসার মাহমুদ ও মারুফ রেজাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় (ইনসেটে সগিরা মোর্শেদ) -ফোকাস বাংলা

রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় পারিবারিক দ্বন্দ্বে গুলিতে নিহত গৃহবধূ সগিরা মোর্শেদ সালাম হত্যা মামলার ৩৫ বছর পর দেওয়া রায়ে দু'জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া তিনজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। বুধবার ঢাকার তিন নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আলী হোসাইন এই রায় ঘোষণা করেন। যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- মারুফ রেজা ও আনাস মাহমুদ।

মামলায় অপর তিন আসামি ডা. হাসান আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদ ওরফে শাহীন এবং মন্টু মন্ডলের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাদের খালাস দিয়েছেন। রায় ঘোষণার সময় আসামিরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। বুধবার রায় ঘোষণা শেষে সাজা পরোয়ানা দিয়ে আসামিদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এসব তথ্য নিশ্চিত করে বাদী পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ জানান, গত ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের তারিখ ৮ ফেব্রম্নয়ারি ধার্য করেন আদালত। তবে ওইদিন রায় পিছিয়ে ২০ ফেব্রম্নয়ারি ধার্য করা হয়। ওইদিনও রায় প্রস্তুত না হওয়ায় তা পিছিয়ে ১৩ মার্চ দিন ধার্য করেন আদালত। মামলাটিতে এখন পর্যন্ত ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।

মামলার নথি অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই সগিরা মোর্শেদ সালাম রাজধানীর বেইলি রোডের ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে সারাহাত সালমাকে আনতে যান। যাওয়ার পথে

তিনি স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছালে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। আত্মরক্ষায় একপর্যায়ে সগিরা মোর্শেদ দৌড় দিলে তাকে গুলি করা হয়। পরে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। ঘটনার দিনই রমনা থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন নিহত নারীর স্বামী সালাম চৌধুরী।

সগিরা মোর্শেদ হত্যাকান্ডের প্রায় ৩০ বছর পর ২০১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি আদালতের জিআর শাখায় অভিযোগপত্র জমা দেন পুলিশ বু্যরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) পুলিশ পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম। ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। এতে বলা হয়, মূলত পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে হত্যার পরিকল্পনা করে আসামিরা। পরিকল্পনামাফিক তা বাস্তবায়নের জন্য ভাড়াটে সন্ত্রাসী নিয়োগ দেওয়া হয়।

এ হত্যাকান্ডে প্রত্যক্ষদর্শী এক রিকশাচালক জড়িত দু'জনের কথা বললেও মিন্টু ওরফে মন্টু নামের একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি মন্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। নেওয়া হয় সাত জনের সাক্ষ্য। বাদীপক্ষের সাক্ষ্যে আসামি মন্টু ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসানের নিকটাত্মীয় মারুফ রেজার নামও আসে। সাক্ষ্যগ্রহণের সময় মারুফ রেজার নাম আসায় রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ২৩ মে বিচারিক আদালত অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। এ আদেশের বিরুদ্ধে মারুফ রেজা হাইকোর্টে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ২ জুলাই হাইকোর্ট রুল দিয়ে অধিকতর তদন্তের আদেশ স্থগিত করেন। পরে স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ান। থমকে যায় মামলার কার্যক্রম।

বিষয়টি নজরে এলে ওই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি নিয়ে ২০১৯ সালের ২৬ জুন হাইকোর্ট মামলার অধিকতর তদন্তের আদেশে এর আগে দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেন। একই সঙ্গে ৬০ দিনের মধ্যে ওই মামলার অধিকতর তদন্ত শেষ করতে পিবিআইকে নির্দেশ দেন। তদন্ত শেষে পিবিআই চার জনের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। একই বছরের ২ ডিসেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেওয়া হয়।

রহস্য জানা যায় রিকশাচালকের তথ্যে

প্রত্যক্ষদর্শী ওই রিকশাচালকের নাম ছালাম মোলস্না। ছালামের সামনে ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই রমনা এলাকায় সগিরা মোর্শেদ খুন হন। রিকশাচালকের দেওয়া তথ্যে চাঞ্চল্যকর এই খুনের মামলার প্রকৃত রহস্য উদ্‌?ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে পিবিআই।

মামলার কাগজপত্র ও পিবিআইয়ের তথ্য বলছে, সগিরা মোর্শেদ ও তাঁর স্বামী আবদুস সালাম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। পারিবারিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয় ১৯৭৯ সালের ২৫ অক্টোবর। তাঁদের তিন কন্যাসন্তান রয়েছে। তাঁরা রাজারবাগের একটা বাসায় বসবাস করতেন।

১৯৮৯ সালে এই দম্পতির মেয়ে সারাহাত সালমার বয়স ছিল ৮ বছর। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী ছিল সে। মেয়েকে স্কুল থেকে আনার জন্য রাজারবাগের বাসা থেকে সেদিন বিকাল পাঁচটায় রওনা হন সগিরা। রাজারবাগ মোড় থেকে চার টাকায় রিকশাচালক ছালামকে ভাড়া করেন।

ছালাম মালিবাগ পেট্রলপাম্প থেকে শান্তিনগর মোড় দিয়ে ভিকারুননিসা স্কুলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সগিরা অল্প সময়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য মৌচাকের গলি দিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। সগিরার কথা অনুযায়ী, ছালাম মৌচাকের গলি পার হয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিকে যাচ্ছিলেন।

স্কুলের অদূরে রিকশার গতিরোধ করে একটি মোটর সাইকেল। মোটর সাইকেলের দু'জন লোক ছিলেন। একজন ছিলেন লম্বা, তার মুখ লম্বাকৃতির। গোঁফ ছিল পাতলা। আরেকজন ছিলেন খাটো, স্বাস্থ্যবান। দু'জনের একজন তখন মোটর সাইকেল থেকে নেমে সগিরার কাছে থাকা ব্যাগ ছিনিয়ে নেন। আর বাঁ হাতের চুড়ি ধরে টানাটানি করতে থাকেন। তখন সগিরা মোর্শেদ ওই লোকের উদ্দেশে বলেছিলেন, 'আমি কিন্তু তোমাকে চিনি।'

অভিযোগপত্র অনুযায়ী, তখন সগিরাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়, যা তার বুকের বাঁ পাশে লাগে। গুলির শব্দ শোনার পর স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসেন। তখন ফাঁকা গুলি করে শান্তিনগরের দিকে পালিয়ে যান ওই দুই ব্যক্তি। সগিরা মোর্শেদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রিকশাচালক ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত হিসেবে মন্টু ও মারুফ রেজাকে শনাক্ত করলে তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

পিবিআইয়ের অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল, মূলত পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে হত্যার পরিকল্পনা করেন আসামিরা। পরিকল্পনামাফিক তা বাস্তবায়নের জন্য ভাড়াটে সন্ত্রাসী নিয়োগ দেওয়া হয়।

যে কারণে খালাস ৩ জন

সর্গিরা মোর্শেদ হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে 'পারিবারিক বিরোধের' কথা থাকলেও সাক্ষ্য-প্রমাণে ?অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় তিনজনকে মুক্তি দিয়েছেন বিচারক। তারা হলেন- সগিরার ভাশুর চিকিৎসক হাসান আলী চৌধুরী (৭১), তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন (৬৫) ও মিন্টু ওরফে মন্টু মন্ডল।

আসামি পক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, 'মামলার বিচার চলাকালে সাক্ষ্যে পারিবারিক বিরোধের বিষয়টি আসেনি। মামলার বাদীও সাক্ষ্যে পারিবারিক বিরোধের বিষয়টি উলেস্নখ করেননি। পিবিআইয়ের দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়- সগিরা মোর্শেদের পরিবারের সঙ্গে আসামি শাহিনের বিভেদ তৈরি হয়েছিল। এছাড়া সগিরাকে অনেক অপছন্দ করতেন এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে সগিরা-শাহিনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। সম্বোধন করা নিয়েও পারিবারিক দ্বন্দ্ব ছিল। সাক্ষ্য প্রমাণে এসব কিছু বাদীপক্ষ প্রমাণ করতে না পারায় বিচারক তাদেরকে খালাস দিয়েছেন।'

কাজল বলেন, 'রায়ে পারিবারিক বিরোধের বিষয়টি জোরালোভাবে রাষ্ট্রপক্ষ তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। বাদীর অপর ভাই যিনি সবার জ্যেষ্ঠ, তার সাক্ষ্য নিতে ব্যর্থতার কারণে বিচারক পারিবারিক বিরোধের বিষয়টিতে অনর্থক মনোভাব পোষণ করেন।'

এদিকে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের কথা জানিয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ বলেন, "এই মামলায় চারজন আসামি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। সেখানে দু'জনেরটা গ্রহণ করে সাজা দিয়েছেন, আর দু'জনেরটা গ্রহণ না করে খালাস দিয়েছেন। আদালতকে হয় পুরো বিষয়টা গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে। কিন্তু এখানে আংশিক গ্রহণ করে রায় দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয় দুইপক্ষকে সন্তুষ্ট করতে এই 'গোঁজামিলের রায়' দেওয়া হয়েছে। আমরা আপিলে যাব।"

ফারুক আহমেদ বলেন, 'মন্টুর খালাসের ব্যাপারে সবাই আগে থেকে জানতেন। আগের বিচারক বলেছিলেন, মন্টুকে অব্যাহতি দিলাম না। তাকে খালাস দেওয়া হবে।'

বেইলি রোডের বাসিন্দা মারুফ রেজা একজন আবাসন ব্যবসায়ী। তিনি এরশাদ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানের ভাগ্নে। সগিরা মোর্শেদকে গুলি করেন তিনি।

পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার তদন্তের পর বলেছিলেন, "স্ত্রীর কথায় প্ররোচিত হয়ে' ছোট ভাইয়ের বউকে শায়েস্তা করার জন্য ২৫ হাজার টাকায় সেসময় বেইলি রোড এলাকার 'সন্ত্রাসী' মারুফ রেজাকে ভাড়া করেছিলেন ডা. হাসান। মারুফকে সহযোগিতার জন্য স্ত্রীর ভাই রেজওয়ানকে তিনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন।"

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে