সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতনীতি নিয়ে বিভক্ত বিএনপি

বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করলেও ভারত নির্বাচনে একতরফাভাবে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি সমর্থন দিয়েছে বলে বিএনপি ক্ষুব্ধ
হাসান মোলস্না
  ২৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের অবস্থান এবং একটি দলকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানানোর ঘটনায় বিএনপিতে ক্ষোভ আছে। তবে এ নিয়ে প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী অবস্থানে যাওয়ার ক্ষেত্রেও আপত্তি আছে দলটির প্রভাবশালী একটি অংশের। অন্যদিকে বিএনপির একটি বড় অংশ দলের আশির দশকের ভারতনীতি অনুসরণ করার পক্ষে। সব মিলে এই ইসু্যতে বিএনপিতে মতানৈক্য এখন তুঙ্গে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করলেও ভারত নির্বাচনে একতরফাভাবে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি সমর্থন দিয়েছে বলে বিএনপি ক্ষুব্ধ। প্রভাবশালী ওই দেশের সমর্থনের কারণেই ক্ষমতাসীনরা আবারও একতরফা নির্বাচন করতে পেরেছে বলে তাদের বিশ্বাস। সেই ক্ষোভ থেকে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বিএনপি নেতারা ভারতবিরোধী অবস্থানকে বিভিন্ন বক্তব্যে-বিবৃতির মাধ্যম সামনে আনেন। তবে এটিকে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ এবং দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে চালানোর চেষ্টা করেছে দলটি। কিন্তু সেটাকে বারাবারি পর্যায়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী নন দলের উচ্চ পর্যায়ের একটি অংশ ও কূটনৈতিক উইংয়ের নেতারা। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর ভারতের পণ্য বর্জনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে নিজের গায়ের ভারতীয় শাল রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলার কর্মসূচিতে দলের অনেকে বিস্মিত। গত বুধবার নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ভারতীয় চাদর ছুড়ে ফেলে দিয়ে তিনি ভারতের পণ্য বর্জনের আন্দোলনকে সমর্থন জানান। এরপর থেকেই ভারতের পণ্যবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সরাসরি সম্পৃক্ততার বিষয়টি সামনে আসে। মানুষের মধ্যে জানার আগ্রহ বাড়তে থাকে বিএনপি কি ভারতনীতির পরিবর্তন করেছে?

এ বিষয়ে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা যায়, বিএনপিতে ভারত বিদ্বেষ আছে। তবে তা প্রকাশ্যে আনার পক্ষে নন অনেকে। ভারতীয় পণ্য ছুড়ে দিয়ে রিজভীর অবস্থান এবং এটি তার ব্যক্তিগত অবস্থান হিসেবে ঘোষণা দেওয়া নিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরে আছে নানা আলোচনা সমালোচনা। দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে এমন একটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে দলকে না জড়ানো রিজভীর বিচক্ষণতা উলেস্নখ করে অনেকে তার প্রশংসা করছে। আবার অনেকে মনে করছেন মহাসচিব দেশে নেই এমন অবস্থায় রিজভীর যেকোনো কার্যক্রমের সঙ্গে দলের সংশ্লিষ্টতা নেই বলার কোনো সুযোগ নেই।

ভারতের পণ্য বর্জনের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশের এই ঘটনাকে অনেকে বিএনপির অবস্থান মনে করলেও তা মানতে

নারাজ দলটির শীর্ষ পর্যয়ের কিছু নেতা। তবে স্পর্শকাতর এই বিষয়ে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে নারাজ। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলের নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য ভারতের একটি গণমাধ্যমে দলের অবস্থান তুলে ধরে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তবে এর একদিন পরেই দলের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে ওই নেতার বক্তব্যকে তার ব্যক্তিগত বলে উলেস্নখ করা হয়। মূলত সেখান থেকেই আর কোনো নেতা ভারতের বিষয়ে বিএনপির অবস্থান নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে নারাজ।

এ বিষয়ে দলটির কূটনৈতিক উইংয়ের একজন সদস্য বলেন, গত বুধবার দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার ভারতবিরোধী অবস্থানকে দলের অবস্থান হিসেবেই মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এটা বেশি বেশি হয়েছে। এটাকে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের কৌশল বলা যাবে না। আসলে ভারতের পণ্য বর্জনে আন্দোলনে বিএনপির মৌন সমর্থনই যথার্থ ছিল।

ভারতনীতি নিয়ে বিএনপিতে যে বিভক্তি আছে তা প্রমাণ হয় সম্প্রতি দেওয়া দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতদের বিপরীতমুখী বক্তব্যে। শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, বিদেশি সব রাষ্ট্রই বিএনপির বন্ধু। কারও সঙ্গে বৈরিতা নেই। যারাই বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে তারাই জনগণের প্রকৃত বন্ধু। এর তিনদিন আগে এই নেতা আরেক অনুষ্ঠানে বলেন, সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামো উত্তর কোরিয়ার মতো তৈরির চেষ্টা করছে। তাই বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিএনপি ভারতের সাহায্য চায়।

শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে দলের আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, 'বিদেশে আমার কোনো প্রভু নেই। দেশের জনগণই আমাদের শক্তি। কিন্তু বর্তমান সরকারের মূলশক্তি জনগণ নয়, প্রভু রাষ্ট্র। নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীনরা বলেছেন বিএনপি বিদেশিদের কাছে ধর্ণা দেয়। এখন ওবায়দুল কাদেরের কথায়ই প্রমাণ হয়েছে এ সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়নি, ভারতের দয়ায় জোর করে আবারও ক্ষমতায় এসেছে।'

শনিবার এক অনুষ্ঠানে ভারতের আনুগত্য নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশ চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, একটি রাষ্ট্রের প্রতি নতজানু পররাষ্ট্রনীতি বর্তমান শাসক দলের অভ্যাস। তাদের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন বিপদে পড়ে তখন বলেন যে, 'দিলিস্ন আছে আমরা আছি।' এই ধরনের কথা বলতে লজ্জ্বাবোধও তাদের হয় না। দিলিস্ন থাকলে এই সরকার আছে। ৭১ সালে এজন্য যুদ্ধ করেছি? রা?ওয়ালপিন্ডি থেকে সরে এসে কি দিলিস্নর অধীনস্থ হওয়ার জন্যই যুদ্ধ করেছি? কখনই না।

বিএনপি সূত্র মতে, ভারত নিয়ে দলের নানা মত থাকলেও দেশটির পণ্য বর্জনের চলমান আন্দোলন সরকারকে বেকাদায় ফেলতে বড় ভূমিকা রাখবে- এমনই বিশ্বাস বিএনপি নেতাদের। তাই এই ইসু্যতে দলের করণীয় ঠিক করতে সম্প্রতি উচ্চ পর্যায়ের ভার্চুয়াল বৈঠক হয়েছে। সেখানে শীর্ষ নেতারা ভারতবিরোধী অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে এক ধরনের নির্দেশনাও এসেছে।

বৈঠকে অংশ নেওয়া নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক এক ছাত্রনেতা বলেন, শীর্ষ পর্যয়ের নেতারা আগের ভারতনীতিতে ফেরাকে এখন সব চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। সেই হিসেবে আশির দশকে বিএনপি যে ভারতনীতি গ্রহণ করেছিল সে পথে হাঁটতে চায় দলটি। বৈঠকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়, সেই সময় দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান প্রকাশ্যে ভারত বিরোধিতা করতেন এবং ভারতকে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করতেন যে, শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলেই বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে না। এজন্য সব পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক করতে হবে ভারতকে। আর এর ফলে ৯০ এর দশকে বাংলাদেশ কূটনীতির পরিবর্তন করেছিল নট অল ফুডস ইন ওয়ান বাস্কেট; এই নীতি গ্রহণ করে। ভারত সব দলের সঙ্গে এমনকি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছিল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে