বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

মেগা প্রকল্পে অর্থায়ন কমায় ঋণ কমছে ব্যাংক খাতে

এম সাইফুল
  ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
মেগা প্রকল্পে অর্থায়ন কমায় ঋণ কমছে ব্যাংক খাতে

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার হার আগের চেয়ে কমেছে। এমনকি এ পর্যন্ত নেওয়া ঋণের পরিমাণ বাজেটে ধরা লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক কম। সরকারের উন্নয়ন বাজেটের ব্যয় ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় ঋণ নেওয়া কমেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

জানা গেছে, সরকার প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাজেট ব্যয় মেটাতে বৈদেশিক দাতা সংস্থাগুলোর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেওয়া আগের থেকে কমেছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের মতো বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় অর্থের চাহিদা কমেছে। মেগা প্রকল্পের মধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলমান রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, সরকার জুলাই ২০২৩ থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে ৬ হাজার ২০৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৯ হাজার কোটি টাকা।

তবে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে ঋণ সামান্য বেড়েছে। তবুও দুই খাত মিলিয়ে ঋণের পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ কমেছে। জুলাই ২০২৩ থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ঋণ নিয়েছে ৮ হাজার ৭০১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা।

দীর্ঘদিন থেকে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ ছিল ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ কমানোর। কিন্তু বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে

গিয়ে সরকারকে ঋণ নিতে হয়েছে। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম থেকেই সরকার অভ্যন্তরীণ ঋণ কমিয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংক ঋণ একেবারে কমে এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে।

গত এক বছরের বেশি সময় ধরেই ব্যাংক ঋণ কমছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকার ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার তুলনায় আগের ঋণ বেশি পরিশোধ করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের নিট ঋণ ছিল ঋণাত্মক ৭ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। যদিও চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাত থেকে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ২৭ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে; আর এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে ৩৪ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের নিট ঋণ ছিল ২৬ হাজার ৯৭ কোটি টাকা।

একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের জন্য সরকার সব ধরনের উন্নয়ন ব্যয় ব্যাপকভাবে কমানোর কারণে সরকারের ঋণ নেওয়া কমে গেছে। উন্নয়ন ব্যয় কমানোর সঙ্গে সঙ্গে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগের ঋণ পরিশোধ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন সরকারকে ঋণ দেয়, তখন কার্যত অর্থনীতিতে নতুন অর্থ প্রবেশ করে। এর ফলে ভোক্তা পর্যায়ে পণমূল্য এবং মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়েছিল ৯৮ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নিয়েছিল ২৫ হাজার ২৯৬ কোটি টাকার ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, জাতীয় নির্বাচনের আগে উন্নয়ন বাজেটে কম ব্যয় করতে চাওয়ায় এই সময়কালে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কম ছিল। এ সময়ে কর রাজস্ব আহরণে ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সরকারকে ব্যয় মেটাতে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে খুব সম্ভব সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। শেষপর্যন্ত ব্যাংকিং উৎস থেকে আরও ঋণ নিতে হতে পারে।

ব্যাংক ঋণের মতো সঞ্চয়পত্র থেকেও সরকারের ঋণের পরিমাণ ঋণাত্মক রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে সরকারের নিট ঋণ ছিল ৪ হাজার ২৮৭ কোটি। যদিও এই খাত থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি কমানো। সে লক্ষ্যেই সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়া কমিয়েছে।

এদিকে চলতি অর্থবছরে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা গত অর্থবছরের চিত্রের ঠিক বিপরীত। সেসময় সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেকর্ড ৯৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। এটি মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে উলেস্নখ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে নেওয়া সরকারের ঋণের মোট পরিমাণ ছিল এক লাখ এক হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। গত দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে থাকায় সরকার চলতি অর্থবছরে ঋণনীতি পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে।

গত বছরের জুলাই ও আগস্টে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেয়নি। বরং ফেরত দিয়েছে ২২ হাজার ৮৮ কোটি টাকা।

তবে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ১৮ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে দুই হাজার ৮৬২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।

মূল্যস্ফীতি না কমা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ না নিতে মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন যে সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ কম নিতে হবে। এটি শুধু মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্যই নয়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যাতে তারল্য সংকটে না পড়ে এবং যাতে উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত তহবিল পান।

এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বাড়িয়ে ৭.৭৫ শতাংশ করেছে। যদিও এক বছর আগে এই পলিসি রেট ছিল ৬ শতাংশ। এছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদহারের ৯ শতাংশ সীমা তুলে দিয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদহার প্রায় ১২ শতাংশের কাছাকাছি যা বাজারে টাকার প্রবাহ আরও কমিয়ে দিয়েছে। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, সরকারের উন্নয়ন ব্যয় কমায় ঋণের চাপ নেই। বরং ঋণ পরিশোধ করেছে। জাতীয় নির্বাচনের জন্য কিছু উন্নয়ন ব্যয় কম ছিল। তবে আগামী দিনগুলোতে যদি আবার ব্যয় বাড়ে তাহলে ঋণ করতে হবে। কারণ বৈদেশিক ঋণের প্রবাহ কম।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে