কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত হত্যা, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। এছাড়া বৃহস্পতিবার সিএমএম আদালতে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের আসামি করে আরও দুটি হত্যা মামলা হয়েছে।
এদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে গণহত্যার অভিযোগ তদন্তে বুধবার আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনোয়ার হোসেন তামিম।
তিনি বৃহস্পতিবার বলেন, 'অভিযোগটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালের তদন্ত সংস্থা। তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক (প্রশাসন) আতাউর রহমানকে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। বুধবার রাতেই তিনি কাজ শুরু করেছেন। তিনি পেপার ওয়ার্ক করবেন। ঘটনাস্থলে যাবেন।' ৭ দিনের মধ্যে তদন্তের অগ্রগতি কর্মকর্তা আতাউর জানাবেন বলে জানান ওই আইনজীবী।
সরকারি চাকরিতে কোটা আন্দোলনের সময় নিহত বাগেরহাটের আরিফ আহমেদ সিয়ামের বাবা বুলবুল কবিরের পক্ষে ওই আবেদন করেন তামিম। এ আবেদনে আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ আরও ৯ জনের বিরুদ্ধে তদন্তের আবেদন জানানো হয়েছে।
আইনজীবী তামিম জানান, একই ধরনের আরেকটি ঘটনায় মেহেদী (২০) নামের এক ছাত্রের বাবা অভিযোগ করেছেন ট্রাইবু্যনালে।
মেহেদী মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার সানাউলস্নাহর ছেলে; মেহেদী চট্টগ্রাম রোডে নিহত হয়েছেন বলে তামিম জানান।
শেখ হাসিনা ছাড়াও অন্য যাদের বিরুদ্ধে তদন্তের আবেদন করা হয়েছে, তারা হলেন- সাবেক সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত।
এছাড়া রয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুলস্নাহ আল মামুন, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশীদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান,র্ যাবের সাবেক মহাপরিচালক হারুন অর রশিদ।
একই অপরাধে ব্যক্তির পাশাপাশি দল ও সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছে বলে জানান আইনজীবী তামিম।
হেলিকপ্টার থেকে গুলি
মামলা
গণআন্দোলনে ক্ষমতাচু্যত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা হয়েছে, এবারের মামলাটি করেছেনর্ যাবের হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে নিহত এক শিশুর মামা।
নিহত মাদ্রাসা ছাত্র জোবাইদ হোসেন ইমনের (১২) মামা আব্দুলস্নাহ আবু সাঈদ ভূঁইয়া বৃহস্পতিবার ঢাকার হাকিম আদালতে মামলার আবেদন করলে মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরী বাদীর জবানবন্দি নিয়ে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দেন।
শেখ হাসিনাসহ মোট ১৬ জনের নাম রয়েছে এ মামলার আসামির তালিকায়।
বাকিরা হলেন- সাবেক সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক স্থানীয় সরকার ও পলস্নী উন্নয়ন মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহামুদ, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মো. এ আরাফাত, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুলস্নাহ আল মামুন,র্ যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. হারুন-অর-রশিদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) খ মহিদ উদ্দিন, ডিবির অতিরিক্ত ডিআইজি হারুন অর রশীদ, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপস্নব কুমার সরকার।
এছাড়ার্ যাবের হেলিকপ্টার টহল টিমের অজ্ঞাতনামা সদস্য এবং তাদের কমান্ডিং অফিসারদেরও আসামি করা হয়েছে এ মামলায়।
মামলার আবেদনে বলা হয়, জোবাইদ হোসেন ইমন মোহাম্মদপুরের দারুন্নাজাত ইসলামিয়া মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সময় সেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিক্ষোভে গিয়েছিল।
১৯ জুলাই সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুরের আলস্নাহ করিম মসজিদের সামনের্ যাবের হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছুড়লে একটি গুলি জোবাইদের বাম কানের উপর দিয়ে প্রবেশ করে ডান কানের নিচ দিয়ে চোয়াল ভেদ করে বেরিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন জোবাইদকে ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।
বাদীর আইনজীবী তারেক আবদুলস্নাহ শুনানিতে আদালতকে বলেন, 'শিশুটিকে স্নাইপার দিয়ে গুলি করা হয়েছে। বাদী বার বার চেষ্টা করলেও সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল থেকে ভিকটিমের ডেথ সার্টিফিকেট নিতে পারেননি। ফলে এ বিষয়ে থানায় মামলা করা যাচ্ছে না, তাই আমরা আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি।'
আরও একটি হত্যা মামলা
রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক শাহাবুদ্দিনকে (৩৫) হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে এই মামলার আবেদন করেন শাহাবুদ্দিনের বাবা আবুল কালাম। সিএমএম আদালত বৃহস্পতিবার মামলাটি এজাহার হিসেবে রেকর্ড করার জন্য শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেন। এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন বাদীর আইনজীবী লিটন মিয়া।
মামলার অপর আসামিরা হলেন- সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল-মামুন, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, অতিরিক্ত কমিশনার মো. হারুন অর রশীদ ও যুগ্ম কমিশনার বিপস্নব কুমার সরকার।
মামলার আরজির তথ্য বলছে, গত ৫ আগস্ট শেরেবাংলা নগর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান শাহাবুদ্দিন।
এর আগে শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে গত মঙ্গলবার একটি মামলা হয় মোহাম্মদপুর এলাকার মুদি দোকানি আবু সায়েদ নিহত হওয়ার ঘটনায়।
গত বুধবার হয় আরও দুটি মামলা। রাজধানীর কাফরুলে কলেজছাত্র ফয়জুল ইসলাম হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় মামলা রেকর্ড করার আদেশ দেন আদালত। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সোহেল রানাকে অপহরণের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মামলা হিসেবে গ্রহণ করতে গতকাল উত্তরা পশ্চিম থানাকে নির্দেশ দেন আদালত।
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে তিনি দেশ ছাড়েন। এখন তিনি ভারতে অবস্থান করছেন।