চট্টগ্রামে বেড়েই চলেছে ডেঙ্গু রোগী ও নিহতের সংখ্যা। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে একজন পুরুষ ও একজন নারীর মৃতু্য হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত ২৮ জনের মৃতু্য হয়েছে। এ ছাড়া নগরের ২৩টি এলাকাকে ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ 'লাল' তালিকাভুক্ত করা হয়েছে ৬টি এলাকাকে। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে নগরের ৩৭ শতাংশ বাড়িতে পাওয়া গেছে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভা। হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় এখনো জোরদার করা হয়নি মশক নিধন কার্যক্রম।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৫২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ ২৯, নারী ১৮ ও শিশু ৫ জন রয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৯৮ জন। এর মধ্যে নগরে ১ হাজর ৯৮৩ এবং উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ১১৫ জন। ২০২৩ সালে নগর ও বিভিন্ন উপজেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সরকরি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় মোট ভর্তি হয়েছিলেন ১৪ হাজার ৮৭ জন। এর মধ্যে মারা যান ১০৭ জন। এ ছাড়া ২০২২ সালে মোট আক্রান্ত ৫ হাজার ৪৪৫ জনের মধ্যে মারা যান ৪১ জন। এর আগে ২০২১ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ২৭১ জন এবং মারা যান ৫ রোগী।
জানা গেছে, জেলা কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদাওছের নেতৃত্বে সেপ্টেম্বরের ১৭ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত জরিপ কাজ চালানো হয়। এতে অংশ নেন কার্যালয়টির কীটতত্ত্বীয় কূশলী সৈয়দ মো. মঈন উদ্দীন ও মো. রিয়াজ উদ্দীন। এসময় তারা নগরের বিভিন্ন এলাকার ২০০টি বাসাবাড়ি থেকে এডিস মশার উৎসের নমুনা সংগ্রহ করে। ১৯৪টি পাত্র থেকে সংগ্রহ করা নমুনার ৬৯টিতে লার্ভার অস্তিত্ব মিলেছে। সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ লার্ভা মিলেছে পরিত্যক্ত পস্নাস্টিক ড্রাম ও বাস্কেটে।
জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, বিভিন্ন এলাকার ২০০ বাসাবাড়ি থেকে এডিস মশার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তার মধ্যে ৭৪টিতে এডিস মশার লার্ভার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যা ৩৭ শতাংশ। এ ছাড়া ১৯৪ কন্টেইনারে থেকে সংগ্রহ করা নমুনার মধ্যে ৬৯ কন্টেইনারে পজিটিভ পাওয়া যায়। যা ৩৬ শতাংশ। এ ছাড়া পস্নাস্টিক ড্রাম ও বাস্কেটে ৪০, টায়ারে ৩৭, মাটির পাত্রে ১২, পস্নাস্টিক জার ও শিটে ৬, পানির ট্যাংক, ফুলের টব ও এলুমিনিয়ামে ৩ এবং ভবনের লিফটের নিচে জমানো পানিতে ২ শতাংশ লার্ভা পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক 'ব্রম্নটো ইনডেক্স' নামে পরিচিত। আর কতগুলো বাড়িতে এডিস মশার উপস্থিতি রয়েছে, তা পরিমাপের সূচক হলো হাউস ইনডেক্স। জরিপে দেখা যায়, ৮ ওয়ার্ডে ব্রম্নটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি। এর অর্থ হচ্ছে, এসব এলাকার ১০০টির মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে মশা বা লার্ভা পাওয়া গেছে। ওয়ার্ডগুলো হলো-৪ নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডের বহদ্দারহাটে ৮০ শতাংশ, ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডের শেরশাহ-বায়েজিদে ৬০ শতাংশ, ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডের পাহাড়তলীতে ৪৫ শতাংশ, ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডে ৪০ শতাংশ, ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ও কোতোয়ালিতে ৩০ শতাংশ, ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের উত্তর ও দক্ষিণ খুলশীতে ২৫ শতাংশ, ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডের হালিশহর এলাকায় ২০ শতাংশ এবং ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ডে ২০ শতাংশ।
এক মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য পর্যালোচনায় চট্টগ্রাম সিভিল সার্জনের জরিপে নগরের যেসব এলাকা হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছে তা হলো: চট্টগ্রাম নগরের ৪১টি ওয়ার্ড রয়েছে। এর মধ্যে নগরের কোতোয়ালি, বাকলিয়া, বায়েজিদ, বন্দর, পাহাড়তলী ও আবাসিক এলাকা খুলশীকে 'লাল' তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ হলুদ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে পাঁচলাইশ, হালিশহর, পতেঙ্গা, চান্দগাঁও ও ডবলমুরিং এলাকাকে। নীল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে আবাসিক এলাকা নাসিরাবাদ এবং লালখান বাজার, আগ্রাবাদ, মুরাদপুর, আকবর শাহ, কাট্টলী ও দামপাড়াকে। এ ছাড়া নগরের অক্সিজেন, সিটি গেট, চৌমুহনী ও সদরঘাট এলাকাকে সবুজ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এসব এলাকায় গত সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে বেশি ৫১৫ জন আক্রান্ত হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে জরিপে।
নগরের খুলশী এলাকার বাসিন্দা মো. ইমরান খান বলেন, এখানে মশার অত্যাচার দিনদিন বাড়ছে। তবে কাউকে মশার ওষুধ ছিটাতে দেখিনি। প্রতিনিয়ত আশপাশের অনেকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
পাহাড়তলী এলাকার বাসিন্দা আকাশ সাহা বলেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে মশার অত্যাচার। কিন্তু এখনো পর্যন্ত চোখে পড়েনি কাউকে মশক নিধন কার্যক্রমের। সবসময় ভয়ে থাকতে হয় ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছি কিনা।
জেলা কীটতত্ত্ববীদ এনতেজার ফেরদাওছ বলেন, জরিপে বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করি। এ কাজে আমাদের কর্মীও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। পস্নাস্টিকের ড্রাম, পরিত্যক্ত টায়ারে জমা থাকা পানিতে লার্ভার অস্তিত্ব বেশি।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এডিস মশা নিয়ে চালানো জরিপের ফলাফল এবং কিছু সুপারিশ সিটি কর্পোরেশনকে জানানো হয়েছে। ফলাফল অনুসরণ করে মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস এবং ওষুধ ছিটানো সহজ হবে। পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করতেও কাজে লাগবে। দ্রম্নত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে মশার ঘনত্ব বাড়বে। তাতে পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, রুটিন ওয়ার্ক চলছে। স্প্রে-ম্যানের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। প্রত্যেক ওয়ার্ডে সকালে লার্ভিসাইড ছিটানো হচ্ছে, বিকালে ফগিং চলছে। ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হয়েছে এমন এলাকায় ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। তবে শুধু ওষুধ ছিটিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে নানা কর্মসূচি নিয়েছে চসিক।