শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২

অঢেল সম্পদ মির্জা আজমের স্ত্রীর বেড়েছে প্রায় ৮০ গুণ

ইউসুফ আলী, জামালপুর
  ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
অঢেল সম্পদ মির্জা আজমের স্ত্রীর বেড়েছে প্রায় ৮০ গুণ
মির্জা আজম

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাত বারের সংসদ সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম ক্ষমতার অপব্যবহার, দলীয় প্রভাব ও পেশীশক্তি ব্যবহার করে গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদের সাম্রাজ্য। ১৯৯৬ থেকে ২০০১, এরপর আ'লীগের টানা প্রায় ১৬ বছরে শত শত কোটি টাকা ও অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন প্রভাবশালী এই রাজনীতিবিদ। তার সম্পদের অংশীদার হয়ে তার স্ত্রীর সম্পদও বেড়েছে ৮০ গুণ। এছাড়া তার ভাইসহ পরিবারের অন্যদের সম্পদও বেড়েছে জ্যামিতিক হারে।

অভিযোগ আছে, ক্ষমতাকে পুঁজি করে টেন্ডারবাজি, ঠিকাদারি, জমি দখল, হাউজিং ব্যবসাসহ নানাভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি। বিলাসবহুল একাধিক বাড়ি, বাগানবাড়ি, পস্নট, ফ্ল্যাট, কোল্ডস্টোরেজ, হোটেল ব্যবসা, গরু ও মাছের খামার, পোস্টাল সঞ্চয়সহ নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করায় মির্জা আজমের অর্থ-সম্পদ ফুলে-ফেঁপে হয়েছে বহু গুণ।

আ'লীগের দোর্দন্ড প্রতাবশালী এই নেতার গ্রামের বাড়ি জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার শুকনগরী গ্রামে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত টানা সাত বার দলীয় মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মির্জা আজম। ১৯৯১ সালে সংসদ সদস্য, ১৯৯৬ সালে সরকার দলীয় সাংসদ, এরপর ২০০১ সালে হন সংসদে বিরোধী দলীয় হুইপ এবং ২০০৮ সালে সরকারদলীয় হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হন। পরে ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন। ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে সপ্তমবারের মতো একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় মির্জা আজমের কাছে নগদ টাকা ছিল ২৩ লাখ ৩২ হাজার ৬৮৫। এছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার কোনো জমানো টাকা কিংবা কোনো বিনিয়োগ ছিল না। বিগত তিন বার সংসদ সদস্যের দায়িত্ব পালনের পর বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা, কোম্পানির শেয়ার ও স্টক এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ কোটি ৫৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ টাকা। সব মিলিয়ে ২০২৩ সালে তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ কোটি ৬৪ লাখ ৩০ হাজার ১০০ টাকা।

২০০৮ সালে মির্জা আজমের বার্ষিক আয় ছিল ৪ লাখ ৪৮ হাজার ১৮৫ টাকা। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তার আয় ছিল ১৫ লাখ ৭২ হাজার ৭৮৬ টাকা। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তার বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ২৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩৪২ টাকায়। ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তার বার্ষিক আয় জ্যামিতিক হারে বেড়ে দাঁড়ায় ৩ কোটি ৬৬ লাখ দুই হাজার ৫৭ টাকা।

পেশায় ব্যবসায়ী মির্জা আজম দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় স্থাবর সম্পদ দেখিয়েছেন ৩১ কোটি ১০ লাখ ৮ হাজার ১৯২ টাকা। এরমধ্যে ৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা মূল্যের ১৭ দশমিক ৬৩ একর কৃষি জমি, ১২ কোটি ৮২ লাখ টাকা দামের প্রায় দেড় একর অকৃষি জমি, ১১ কোটি সাড়ে ২৮ লাখ টাকা মূল্যের দু'টি ভবন ও ৩৬ লাখ সাড়ে ১৯ হাজার টাকার একটি ফ্ল্যাট আছে বলে উলেস্নখ করেছেন।

প্রায় ছয় বছর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় মির্জা আজমের স্থাবর সম্পদের মূল্য ছিল ১৩ কোটি ৮২ লাখ ২৮ হাজার ৬২ টাকা। এরমধ্যে কৃষি জমি ২ দশমিক ৪৫ একর থেকে ৯ গুণ বেড়ে ১৭ দশমিক ৬৩ একর হয়েছে। তবে পরের বার তার অকৃষি জমির পরিমাণ কমেছে বলে উলেস্নখ করেছেন।

১৫ বছর আগে তার স্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ২৯ হাজার ৬৫২ টাকা। তখন তিনি বাড়ি বা কোনো অ্যাপার্টমেন্টের কথা উলেস্নখ করেননি। যদিও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় স্থাবর সম্পদের মধ্যে তিনি ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট ও জামালপুরে নয়টি ভবনের কথা উলেস্নখ করেছিলেন।

মির্জা আজমের সম্পদের সঙ্গে পালস্না দিয়ে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে তার স্ত্রীর সম্পদের পরিমাণ। ২০০৮ সালে মির্জা আজমের স্ত্রীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩৭ লাখ ২৬ হাজার ৬৮ টাকা। এরমধ্যে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া নেত্রকোনা শহরে ১০ লাখ টাকা মূল্যের ছয় শতাংশ জমি, ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা মূল্যের ২ দশমিক ১৯ একর কৃষি জমি ছিল বলে উলেস্নখ করেছেন। তখন তার নামে কোনো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পোস্টাল সঞ্চয় ও ব্যবসায়িক মূলধনের তথ্য ছিল না।

বর্তমানে মির্জা আজমের স্ত্রীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৮০ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ কোটি ৫১ লাখ এক হাজার ৪০১ টাকা। এর মধ্যে ২ কোটি ৩৬ লাখ মূল্যের ফ্ল্যাট, ৩ কোটি ৪১ টাকা মূল্যের দু'টি ভবন ও ১ কোটি ১৬ লাখ ৪৭ হাজার ১৬৮ টাকার ব্যবসায়িক মূলধন রয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় মির্জা আজমের স্ত্রীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ছিল ১১ কোটি ১৮ লাখ ৫ হাজার ২৭০ টাকা। কাগজে-কলমে এসব আয় ও সম্পদের বিবরণ দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে মির্জা আজমের সম্পদের পরিমাণ শত গুণ বেশি বলেই মনে করেন স্থানীয়রা।

অভিযোগ আছে, মির্জা আজম তার ভাইদের দিয়ে টেন্ডার, ঠিকাদারি ও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার ভাইয়েরাও হয়েছেন কোটিপতি। মির্জা আজম বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সরিষাবাড়ী উপজেলার ৪টি পাটকল বন্ধ হয়ে যায়। পরে বন্ধ হয়ে যাওয়া এআরএ জুট মিলটি কিনে পস্নট বানিয়ে তিনি তার ভাইদের দিয়ে বিক্রি করে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

২০১৩ সালে জামালপুর শহরের পাঁচরাস্তা মোড় এলাকায় গড়ে তোলা হয় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৯ সালে ব্রহ্মপুত্র নদের ফৌজদারী মোড় এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের সময় ক্যাম্পাসের নামে ব্রহ্মপুত্র নদের ৩০ একর জায়গায় বালি ফেলে ভরাট ও স্থানীয়দের বেশকিছু জমি জোর করে দখলের অভিযোগ ওঠে। জমি কেনার কথা বলে অনেকের জমি দখলে নিলেও পরে তারা টাকা পাননি। এ সময় জমি দিতে অস্বীকার করায় অনেকের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা হয় বলেও জানান ভুক্তভোগীরা।

জামালপুর পৌর শহরের দেউরপাড় চন্দ্রা এলাকায় প্রায় ৬ একর জমির ওপর স্ত্রী আলেয়ার নামে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে আলেয়া গার্ডেন গড়ে তোলেন মির্জা আজম। এই রিসোর্টের মধ্যে ২৬ শতাংশ জমি ছিল দেউরপাড় চন্দ্রার আ'লীগের সাবেক ওয়ার্ড সভাপতি মঞ্জুরুল হক ফজলুর। ১৩ শতাংশ জমির দাম দিয়ে বাকি ১৩ শতাংশ তিনি দখল করেন বলে অভিযোগ আছে।

এছাড়া অর্পিত সম্পতি দখল ও হিন্দু পরিবারকে উচ্ছেদ করে জামালপুর শহরের বকুলতলায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন দলের জেলা কার্যালয়। এখানে ৮ শতাংশ জমিতে বিলাসবহুল ডুপেস্নক্স তিন তলা বাড়ি রয়েছে তার, যার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। শহরের মেডিকেল রোডে তিনতলা আরও দু'টি বাড়ি রয়েছে। বজ্রাপুর এলাকায় মির্জা রাইস মিলটি পরিচালনা করেন তার ভাই মির্জা কবির। এছাড়া মাদারগঞ্জেও রয়েছে আধুনিক মানের বাড়ি। মাদারগঞ্জ পৌর শহরের বালিজুড়ি বাজারে দুই একর জমিতে নুরুন্নাহার মার্কেট ও বকুল মার্কেটের মালিকানা রয়েছে মির্জা আজমের। মাদারগঞ্জ উপজেলা চত্বরে এক একর জমিতে একাধিক মার্কেট ও মেলান্দহ উপজেলায় রয়েছে অসংখ্য জমি। মির্জা আজম নেত্রকোনায় শশুরবাড়িতেও স্ত্রীর নামে করেছেন বিপুল সম্পদ।

ঢাকার ধানমন্ডির ১৫ নম্বর রোডে (পুরনো ২৮ নম্বর) প্রভাব খাটিয়ে সরকারি পস্নট দখল করে বহুতল বাড়ি নির্মাণ করেছেন তিনি। এই রোডের ১২ নম্বর বাসাটিতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসবাস করতেন মির্জা আজম। ১৯৯৬ সালে এমপি থাকাকালে ঢাকার নিকুঞ্জ-২ আবাসিক এলাকায় পাঁচ কাঠার পস্নট বরাদ্দ পেয়েছিলেন তিনি। ২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর প্রভাব খাটিয়ে পস্নটটি পরিবর্তন করে বারিধারায় ১০ নম্বর সড়কে নতুন পস্নট বরাদ্দ নিয়ে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেন।

এছাড়া তিনি আলোচিত তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের অন্যতম শেয়ারহোল্ডার বলেও জানা যায়। কক্সবাজারের পাঁচতারকা সী-গাল হোটেলের অন্যতম অংশীদার মির্জা আজম। এই হোটেলের চেয়ারম্যান মির্জা আজমের স্ত্রী আলেয়া আজম। মির্জা আজমের 'অপি বৃষ্টি' নামে একটি হাউজিং কোম্পানির মালিকানা রয়েছে। তার স্ত্রী আলেয়া আজম এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। মির্জা আজমের ভাই মির্জা আনোয়ার এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। মেলান্দহ উপজেলার দুরমুট ইউনিয়নে তমা কংক্রিট লিমিটেড ও ময়মনসিংহে ভালুকা ডেইরি ফার্ম নামে প্রতিষ্ঠানেও মির্জা আজমের শেয়ার রয়েছে। শেরপুরের নালিতাবাড়িতে 'নালিতাবাড়ি ফিশারিজ'র মালিকও তার স্ত্রী আলেয়া আজম।

রাজনৈতিক নেতাদের চিত্তবিনোদনের জন্য জামালপুর পৌরসভার ডাম্পিং স্টেশনের কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জমি নামমাত্র ভাড়া নিয়ে সাড়ে ৪ একর জায়গায় গড়ে তোলেন রিক্রিয়েশন ক্লাব। ময়লার ভাগাড়ের নির্ধারিত জায়গা দেখিয়ে পৌরসভা ও জেলা পরিষদের চারটি প্রকল্পের কাজ হয়েছে এখানে। বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠানটিতে পৌরসভার তিনটি প্রকল্প ও জেলা পরিষদের একটি ফটক তৈরির প্রকল্পে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

অভিযোগ আছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ক্লাবটি উদ্বোধনের পর থেকেই এখানে চলত মদের আড্ডা, জুয়াসহ নানা অসামাজিক কার্যকলাপ। ক্লাবের সদস্য রয়েছেন ৪৫৯ জন। আ'লীগের প্রভাবশালী নেতা, আমলাদের পাশাপাশি তাদের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা ভূমিদসু্য ও সন্ত্রাসীরারই এই ক্লাবের সদস্য। জামালপুরের মতো একটি অনুন্নত জেলায় গড়ে ওঠা এই ভিআইপি ক্লাবের সদস্য হতে গুনতে হতো ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা। এছাড়া প্রতিমাসে দিতে হতো চাঁদা।

গত ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর মির্জা আজমের জামালপুর ও মাদারগঞ্জের বাড়ি, রিসোর্ট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে তছনছ করে দিয়েছেন এলাকাবাসী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে