'লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসায়' রেপো হিসেবে পরিচিত 'নীতি সুদহার' আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে বাংলাদেশ সফরে এসে আন্তর্জাতিক সংস্থাটির প্রতিনিধিদল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, চার ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক ও পরিচালকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে এই পরামর্শ দিয়েছে। সফরের প্রথম দিন মঙ্গলবার এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এদিকে, প্রতিনিধি দলের সঙ্গে প্রথম বৈঠকের পর অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাটির পর্ষদের অনুমোদন পেলে বাড়তি অর্থ মিলিয়ে চতুর্থ কিস্তিতে মোট ১১০ কোটি ডলার আগামী বছরের 'ফেব্রম্নয়ারি-মার্চের' মধ্যে হাতে পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী অন্তর্র্বর্তী সরকার।
বৈঠকের সূত্র ধরে বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা শিখা বলেন, 'বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণের অর্থছাড়ের আগে প্রতি ত্রৈমাসিকে আইএমএফ থেকে বিভিন্ন শর্তের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়। চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে তাদের একটি প্রতিনিধিদল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে। প্রথম দিনে কয়েকটি
বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে তারা কী করতে চায় সেসব বিষয় তুলে ধরেছে।'
বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে বিভিন্ন শর্ত পরিপালনের অগ্রগতি দেখতে ঢাকা এসেছে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। এর নেতৃত্বে আছেন সংস্থাটির গবেষণা বিভাগের ডেভেলপমেন্ট ম্যাক্রো ইকোনমিকস বিভাগের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, 'নিট রিজার্ভসহ আইএমএফের যেসব লক্ষ্য বাধ্যতামূলক ছিল, তার সবই বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। যদিও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ না হওয়ায় তারা নীতি সুদহার আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।'
এদিন সকালে মুদ্রানীতি ও গবেষণা বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করেন আইএমএফ প্রতিনিধিরা। বৈঠকে তারা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসার কারণ জানতে চান।
বৈঠকে উপস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি, সেটি জানতে চেয়েছে আইএমএফ। তাদের কয়েক দফা নীতি সুদহার বাড়ানোর কথা জানানো হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন পণ্যের আমদানি বাড়াতে করহ্রাস ও টিসিবির আওতায় ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি করার কথা অবহিত করা হয়।
'তারপরও কেন মূল্যস্ফীতি কমছে না'- প্রতিনিধি দলের এমন প্রশ্নের জবাবে আমরা বলেছি, দেশে বড় আকারের বন্যা হয়েছে। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতাও পণ্যমূল্য বাড়াতে প্রভাব ফেলেছে। ডলারের দাম বৃদ্ধিতেও পণ্যমূল্যের দাম বেড়েছে।'
এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যাংক খাতের তারল্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি বৈঠক করে আইএমএফের দুই সদস্যের প্রতিনিধি দল। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে নেতৃত্ব দেন ডেপুটি গভর্নর মো. হাবিবুর রহমান। বৈঠকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বিশেষ ব্যবস্থায় টাকা ধার দেওয়ার কারণ জানতে চায় প্রতিনিধি দল।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'দুর্বল ব্যাংকগুলোকে আমরা যে টাকা দিলাম, বাজারে এটার প্রভাব কী, এ ধরনের ধার দেওয়ার বিষয়টি রেজুলেশনে আছে কিনা, এর বিপরীতে প্রয়োজনীয় জামানত রাখা আছে কিনা, আদায়ের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আছে কিনা, টাকার সঠিক ব্যবহারে শর্তের ধরনসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এর জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জানানো হয়, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে আন্তব্যাংক থেকে যে ধার দেওয়া হয়েছে, তার বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়েছে। এছাড়া টাকা ছাপিয়ে যে তহবিল দেওয়া হয়েছে, তার বিপরীতে প্রমিশনারি নোট এবং রপ্তানি বিল জামানত হিসেবে নেওয়া হয়েছে।'
ঋণের চতুর্থ কিস্তি ১১০ কোটি ডলার
ছাড়ের আশা আগামী ফেব্রম্নয়ারি-মার্চে
এদিকে, ঢাকা সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মঙ্গলবারের প্রথম বৈঠকের পর অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আশা প্রকাশ করেছেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাটির পর্ষদের অনুমোদন পেলে বাড়তি অর্থ মিলিয়ে চতুর্থ কিস্তিতে মোট ১১০ কোটি ডলার আগামী ফেব্রম্নয়ারি-মার্চে হাতে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি সাংবাদিকদের জানান, সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতি ও বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির চাপ সামাল দিতে তৃতীয় কিস্তিতে পরিকল্পনার চেয়ে বাড়তি অর্থ ছাড় করেছিল আইএমএফ। সেবার সব মিলিয়ে ১১৫ কোটি ডলার পেয়েছিল বাংলাদেশ। যদিও পাওয়ার কথা ছিল ৬৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
সচিবালয়ে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের পর অর্থ উপদেষ্টা বলেন, 'চতুর্থ কিস্তি আগামী ফেব্রম্নয়ারি-মার্চের মধ্যে পেয়ে যাব আশা করছি। এবারও বাড়তি অর্থ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তারা।'
প্রতিনিধি দলের সফর শেষে আইএমএফের পর্ষদে চতুর্থ কিস্তির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে ঢাকা ছাড়ার আগে সংস্থাটির কর্মকর্তারা তাদের প্রাথমিক মতামত জানিয়ে দেবেন।
সালেহউদ্দিন বলেন, 'মূলত তারা এসেছে রাজস্ব খাত, বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা, মূল্যস্ফীতি, এগুলো দেখার জন্য। এসব বিষয়ে তারা আমাদের সঙ্গে আলাপ করেছে, এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলাপ করবে।'
ঋণ চুক্তির পরিকল্পনা অনুযায়ী চতুর্থ কিস্তিতে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ আছে ৮ কোটি ৩৩ লাখ এসডিআর (আইএমএফ মুদ্রা)। চতুর্থ কিস্তি পেলে মোট ৩৫ কোটি ২৩ লাখ এসডিআর পেয়ে যাবে বাংলাদেশ, যা মোট ঋণের ৩৩ শতাংশ।
প্রতিনিধি দলটি সরকারের শীর্ষ পর্যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। বাংলাদেশকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে সবশেষ তৃতীয় কিস্তির অর্থের ব্যবহার ও শর্ত পরিপালনের অগ্রগতি দেখতে আইএমএফ মিশন এ সফর শুরু করেছে।
উপদেষ্টা জানান, বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ সংকটের মধ্যে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ঋণ চায়। কয়েক দফা আলোচনা শেষে গত বছরের ৩১ জানুয়ারি ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্থিক সংস্থাটি। এ পর্যন্ত ঋণের প্রায় ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ।
নতুন ৩০০ কোটি ডলার নিয়ে আলোচনা শুরু
এবার আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন করে ৩০০ কোটি ডলার ঋণ চাইবে বাংলাদেশ ব্যাংক, যেটা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে আইমএফের সঙ্গে আলোচনা করেছে।
নতুন ৩ বিলিয়ন ডলারের আনুষ্ঠানিক আবেদন প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, 'চলমান ৪৭০ কোটি ডলার তো প্রথম প্যাকেজের। কিন্তু সংস্কার করতে হলে আমাদের আরও ফান্ড লাগবে। আমাদের অনেক কিছু সংস্কার করতে হচ্ছে যেমন ব্যাংকিং খাত, রাজস্ব খাত। এগুলো করতে আমাদের ফান্ড লাগবে।'
আইএমএফের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে আছেন সংস্থাটির গবেষণা বিভাগের ডেভেলপমেন্ট ম্যাক্রো ইকোনমিকস বিভাগের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও, যিনি তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের সময়ও ঢাকা এসেছিলেন।
উন্নয়ন সহযোগীরা দেবে ৬০০ কোটি ডলার
আইএমএফ এর পঞ্চম কিস্তি ছাড় হওয়ার কথা রয়েছে আগামী বছরের মে মাসে। এর সঙ্গে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও ওপেক ফান্ডসহ চলতি অর্থবছরেই ৬০০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার আশা করছে সরকার।
এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, 'এদের মধ্যে কিছু দিন পরই আলোচনা করতে ঢাকা আসবে এডিবি প্রতিনিধি দল।'