মানব পাচার-সংক্রান্ত মামলার তদন্তে তোড়জোড় চলছে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে থাকা প্রায় পাঁচ শতাধিক মামলার তদন্তে নতুন করে গতি ফিরেছে। সেই সঙ্গে দ্রম্নত তদন্ত করে চার্জশিট দাখিল এবং পাচারকারিদের গ্রেপ্তারে চলমান যৌথ অভিযান অব্যাহত রাখতে বলা হয়েছে।
এদিকে, বিদেশে থাকা মানব পাচারকারিদের গ্রেপ্তার করে দেশে আনতে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থার (ইন্টারপোল) সহায়তা চাওয়া হয়েছে। পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, দেশে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সবচেয়ে বেশি মানব পাচার-সংক্রান্ত মামলা দায়ের হয়েছে। যার মধ্যে- রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি, জয়পুরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর ও নড়াইল উলেস্নখযোগ্য। তবে বেশি মামলা দায়ের হয়েছে কক্সবাজার জেলার থানাগুলোতে। দায়েরকৃত মামলার অধিকাংশই সিআইডি পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট তদন্ত করছে। যার পরিমাণ চার শতাধিক। এসব মামলায় মানব পাচারের পাশাপাশি মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আছে। পুলিশ বু্যরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে শতাধিক মামলা রয়েছে। এ ছাড়া অল্প কিছু মামলার তদন্ত রয়েছে থানা পুলিশ, জেলা ডিবি পুলিশ ওর্ যাবের কাছে।
তদন্তকারী সংস্থাগুলো সূত্রে জানা গেছে, যখন কোনো মানুষ বিদেশে যাচ্ছেন কাজের জন্য, তখন সেটি কোনো অপরাধ বলে গণ্য হয় না। কিন্তু যে কাজ দেওয়ার কথা বলে বিদেশ নেওয়া হচ্ছে, সেই কাজ না দিলেই আইনগতভাবে সেটি অপরাধ। এরপর অন্য কাজ দিলেও সেটি খুব বেশি আমলে বা আলোচনায় আসছে না। কিন্তু অধিকাংশ আদম ব্যবসায়ী অশিক্ষিত ব্যক্তিদের কাজের কথা বলে বিদেশে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তারা নিরূপায় হয়ে পড়ছেন। অধিকাংশ সময়ই তারা বেআইনিভাবে বিদেশে বসবাস করার কারণে ওই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে গ্রেপ্তার হচ্ছেন। তাদের বিষয়ে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হচ্ছে ওইসব দেশ থেকে। এতে দেশের ভাবমূর্তি বিদেশে নষ্ট হচ্ছে। সরকার ওইসব দেশ থেকে কূটনৈতিভাবে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনছে। দেশে ফিরেই তারা দালাল বা যাদের মাধ্যমে বিদেশে গিয়েছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করছেন। এ ধরনের অধিকাংশ মামলা তদন্ত করছে থানা পুলিশ ও জেলা ডিবি পুলিশ।
সূত্রটি বলছে, ওইসব মানুষকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিদেশে নিয়ে জিম্মি করা হয়। তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। এর ভিডিও করে দেশে থাকা তাদের
পরিবারের কাছে পাঠিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়। এসব ঘটনায় মানব পাচার, অপহরণ ও মানিলন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের হচ্ছে। সিআইডির কাছে থাকা মামলাগুলোর অধিকাংশই এ ধরনের। জিম্মির পর নির্যাতনের একপর্যায়ে কেউ মারা গেলে খুনের মামলা হচ্ছে। এসব মামলার অনেকগুলো সিআইডি ও পিবিআই তদন্ত করছে। যে পাঁচ শতাধিক মামলার তদন্ত চলছে, এর অধিকাংশই এই ক্যাটাগরির।
তদন্তকারী সংস্থাগুলো বলছে, বিদেশে ভালো বেতনে চাকরি দেওয়ার নাম করে সাধারণত মানব পাচারের ঘটনাগুলো ঘটছে। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে কিছু ট্রাভেল এজেন্সি ও রিক্রুটিং এজেন্সি জড়িত। তারা জড়িত আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারি সিন্ডিকেটের সঙ্গে। অথচ টু্যর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সি বা কোম্পানির বিদেশে কাজের জন্য লোক পাঠানোর কোনো আইনগত সুযোগ নেই। তারা শুধু বিদেশ ভ্রমণের জন্য লোক পাঠাতে পারবে।
তদন্তকারীদের তথ্য মতে, সারাদেশে মানব পাচারের শতাধিক সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয়। তাদের নেটওয়ার্ক গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃত। আর সদস্য সংখ্যা কম করে হলেও ১০ হাজার। তারা ধাপে ধাপে কাজ করে। যে কারণে গ্রামপর্যায়ের দালালরা জেলা পর্যায়ের আদম ব্যবসায়ীদের চিনেন না। এর ওপরের স্তরে থাকাদের চেনার কোনো সুযোগ নেই। জেলা পর্যায়ের সিন্ডিকেট ঢাকায় নির্দিষ্ট কিছু টু্যর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করে। এসব এজেন্সিগুলো পাচারকারি চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেরা এবং অন্যদের মাধ্যমে বিদেশে লোক পাচার করে।
র্
যাব সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার হয় আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারি চক্রের সদস্য আজিজুল হক (৫৬), মোছলেম উদ্দিন ওরফে রফিক (৫০) ও কাউছার (৪৫)। তারা গ্রামের অভাবী পরিবারের সুন্দুরী কম বয়সি ও যুবতী নারীদের টার্গেট করত। টার্গেটকৃত নারীদের পাসপোর্ট ও ভিসা দিয়ে পাঠিয়ে দিত দুবাইতে থাকা চক্রের মূলহোতা ও আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারি চক্রের সদস্য মহিউদ্দিন (৩৭) ও শিল্পীর (৩৫) কাছে। মহিউদ্দিন ও শিল্পী পাচার হওয়া নারীদের আবার বিভিন্ন দেশে থাকা আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারি চক্রের মাধ্যমে বিক্রি বা পাচার করে দিত। গ্রেপ্তার হওয়া তিনজন ৮০ জন নারীকে পাচার করেছে বলে স্বীকার করেছে। পাচার হওয়া নারীদের অনেকেই বর্তমানে দুবাই, সৌদি আরব, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে আছেন। এসব নারীর অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন নাইট ক্লাবে অসামাজিক কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
সূত্রটি বলছে, চক্রের নোয়াখালী অঞ্চলের দায়িত্বে রয়েছে পলাতক নূর নবী ওরফে রানা (৩৫) ও ঢাকা অঞ্চলের দায়িত্বে রয়েছে পলাতক মনজুর হোসেন (৩৩)। চক্রের আরেক নারী সদস্য হচ্ছে পলাতক তাহমিনা বেগম (৪৮)। চক্রের সদস্যরা নারীদের কাছ থেকে ৭-৮ লাখ টাকা করে নিয়ে ভালো চাকরি দেওয়ার কথা বলে দুবাইতে পাঠাত। দুবাই পৌঁছার পর তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়। এরপর তাদের ওপর নেমে আসে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। পরে তাদের অন্য দেশে পাচার করে দেয়। চক্রটিতে সক্রিয় রয়েছে তোফায়েল আহমেদ, আকতার হোসেন, আনিছুর রহমান ও রাসেল নামের আরও চারজন। চক্রের খপ্পড়ে পড়াদের কাছ থেকে প্রথমে পাসপোর্ট, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, ভিসা, মেডিকেল এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ বু্যরোর অনুমতি নেওয়ার কথা বলে ধাপে ধাপে ৭-৮ লাখ টাকা করে নেওয়া হতো।
র্
যাব সূত্র বলছে, এসব মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত কতিপয় অসাধু ট্রাভেল এজেন্সি ও রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক। যাদের প্রকৃতপক্ষে বিদেশে কাজের জন্য লোক পাঠানোর কোনো আইনগত অধিকার নেই। এসব এজেন্সিগুলো শুধুমাত্র সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসার নামে মানব পাচার করে আসছে।
মানব পাচার মামলার তদন্তের বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, মানব পাচারের মামলাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত চলছে। সেই সঙ্গে মানব পাচারের জড়িতদের গ্রেপ্তারে চলমান যৌথ অভিযান অব্যাহত থাকবে। দ্রম্নততার সঙ্গে মানব পাচার মামলা তদন্ত করে চার্জশিট দাখিলের চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে বিদেশে থাকা মানব পাচারকারিদের গ্রেপ্তারে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার আবু ইউসুফ যায়যায়দিনকে বলেন, পিবিআই অনেক মানব পাচার মামলার তদন্ত করছে। যার পরিমাণ কমপক্ষে শতাধিক। মানব পাচারের পর জিম্মি বা অপহরণের ঘটনায় পৃথক মামলা হয়। তবে জিম্মির পর নির্যাতনে কারও মৃতু্য হলে তার সঙ্গে খুনের ধারা যুক্ত হয়। এমন বেশ কিছু মামলা তদন্ত করা হচ্ছে। মানব পাচার-সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রম্নততার সঙ্গে তদন্ত করে চার্জশিট দাখিল করতে সরকারের তরফ থেকে নির্দেশনা এসেছে।
একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, চলতি বছরের ২২ নভেম্বর বাংলাদেশিদের থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় ভ্রমণের ব্যাপারে সতর্ক করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
সর্তক বার্তায় বলা হয়, কিছু অসাধু ব্যক্তি এবং স্ক্যাম প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম বিদেশে ভালো টাকা বেতনে চাকরির বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। যেসব ওয়েবসাইট, ইমেইল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম একাউন্ট থেকে এমন বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে, এর সবই ভুয়া। এসব সামাজিক মাধ্যমে কম্পিউটার অপারেটর, টাইপিস্ট ও কলসেন্টার অপারেটরের মতো পদে আকর্ষণীয় বেতনের চাকরির প্রলোভন দিচ্ছে। এমন প্রলোভনের পেছনে মানব পাচারের ফাঁদ থাকতে পারে বলে মনে করছে সরকার।
সতর্ক বার্তায় আরও বলা হয়েছে, বিদেশে ভ্রমণে বা চাকরি করতে যেতে ইচ্ছুকরা যেন অবশ্যই প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ বু্যরোর মাধ্যমে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাই করেন। মূলত সরকারের এমন সর্তক বার্তা প্রচারের পর থেকেই পাচার পাচার-সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রম্নততার সঙ্গে তদন্ত করতে নির্দেশনা আসে সরকারের তরফ থেকে। কারণ, এমন প্রচারণার সঙ্গে চিহ্নিত মানব পাচারকারি সিন্ডিকেটগুলো জড়িত থাকতে পারে বলে মনে করছে সরকার।