অগ্রহায়ণের বিদায়বেলায় শীত অনুভূত হচ্ছে সারাদেশেই। তবে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের কোথাও কোথাও বইতে শুরু করেছে তীব্র কুয়াশার সঙ্গে হিমেল হাওয়া। এতেই জেঁকে বসেছে শীত। কোথাও কুয়াশা ঝরছে বৃষ্টির মতো। দেশজুড়ে এমন অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে বৃহস্পতিবার দেশের সর্বনিম্ন্ন তাপমাত্রা ১০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা চুয়াডাঙ্গা ও গোপালগঞ্জে। তাপমাত্রার পারদ নেমেছে ভোলা ও মাদারীপুরেও। এদিন ভোলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নথিবদ্ধ করা হয়েছে ১০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর মাদারীপুরে ১১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলার তাপমাত্রা ১০ থেকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এ মাসেই একটি বা দুটি শৈত্যপ্রবাহ হানা দিতে পারে। সেইসঙ্গে বঙ্গোপসাগরে সুস্পষ্ট লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে বলেও জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
স্টাফ রিপোর্টার, চুয়াডাঙ্গা জানান, বৃহস্পতিবার সকালে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলায় ১০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড হয়েছে; যা মৌসুমের সর্বনিম্ন। ফলে কনকনে ঠান্ডায় স্থবির হয়ে পড়েছে এ জেলার জনজীবন।
জেলা আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র পর্যবেক্ষক মো. রকিবুল হাসান জানিয়েছেন, এদিন সকাল ৯টায় চুয়াডাঙ্গার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। যা এই মৌসুমে জেলার এবং দেশেরও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এর আগে জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এদিকে এদিন ভোর থেকেই ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন ছিল চুয়াডাঙ্গার আকাশ। সেইসঙ্গে তীব্র শীত অনুভূত হওয়ায় মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এই বৈরী আবহাওয়ায়ও প্রয়োজনীয় কাজের জন্য ঘরের বাইরে আসতে হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে। বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে হাটবাজারের শ্রমিক ও কৃষি শ্রমিকদের।
আবহাওয়া কর্মকর্তা রকিবুল বলেন, 'এ অবস্থা এখন অব্যাহত থাকতে পারে। কয়েকদিন পর তাপমাত্রা আরও নিচে নেমে আসতে পারে।'
তীব্র শীতের কারণে নিম্নআয়ের শ্রমিক শ্রেণির মানুষদের আয়-উপার্জন কমে গেছে। সন্ধ্যার পর শহরের রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। একইভাবে সকালের দিকে শহরে মানুষের আনাগোনা কম থাকছে। ভ্যান ও রিকশা চালকরা কাঙ্ক্ষিত যাত্রী পাচ্ছেন না।
তীব্র শীতে কৃষি
শ্রমিকরাও পড়েছেন বিপাকে। এখন কৃষির ভরা মৌসুম। মাঠে মাঠে সবজি, বোরো ধানের বীজতলা, আলুসহ অনেক ফসল। এসব ফসলের পরিচর্যার জন্য কৃষি শ্রমিকদের খুব সকালেই কাজের জন্য মাঠে আসতে হয়। শীতের কষ্ট মেনে নিয়েই মাঠে কাজ করতে হচ্ছে তাদের।
সদর উপজেলার বেলগাছি গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, 'দেরি করে মাঠে আসলে সময়মত কাজ শেষ করা যায় না। এজন্য খুব সকাল সকাল মাঠে আসতে হয়। কিন্তু শীতের কারণে সেটা করা যাচ্ছে না। শীতে মাঠে আসতে গেলেও কষ্ট। ধানের বীজতলা বড় হচ্ছে। মাঠে এসে বীজতলায় জমে থাকা পানি ফেলে দিতে হয়। তা না হলে বীজতলার ক্ষতি হবে। এ কাজটিও করতে হয় খুব সকালে এসে।'
এদিক, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে শীতজনিত রোগের প্রকোপও বেড়েছে। বহির্বিভাগে রোগীর চাপ বেশি। বেশিরভাগই ঠান্ডা-সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসছে।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুবুর রহমান মিলন বলেন, 'শীতে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। হাসপাতালের বহির্বিভাগেও রোগীর চাপ বেশি। আবহাওয়ার এই সময়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। শিশুদের যাতে কোনোভাবে ঠান্ডা না লাগে সেদিকে নজর রাখতে হবে। শীতের তীব্রতা বাড়লে বয়স্কদের ঘরের বাইরে বের না হওয়া ভালো।'
স্টাফ রিপোর্টার, গোপালগঞ্জ জানান, জেলার ওপর দিয়ে হিমেল হাওয়া বয়ে যাওয়ায় তীব্র শীতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সূর্যের মুখ দেখা না যাওয়ায় শীতের তীব্রতা দ্বিগুণ অনুভূত হয়েছে। বৃহস্পতিবার জেলায় ১০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে।
তীব্র শীত আর গরম কাপড়ের অভাবে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে ছিন্নমূল, গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষ। কাজে বের হতে পারছেন না তারা। তবে অনেকেই টুপি, মাফলার ও চাদর মুড়ি দিয়ে বাইরে বের হচ্ছেন। ভোরে মহাসড়কসহ বিভিন্ন সড়কে হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচল করেছে। অনেকেই শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ভিড় করছেন হাসপাতালে। আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বয়স্কদের সংখ্যা বেশি।
গোপালগঞ্জ আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু সুফিয়ান জানিয়েছেন, জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা এ মৌসুমের সর্বনিম্ন্ন। এদিন সকাল ৬টায় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৬ শতাংশ। ঘন কুয়াশার কারণে সূর্যের মুখ না দেখা যাওয়া এবং উত্তরের মৃদু হিমেল বাতাস শীতের অনুভূতি বাড়িয়ে তুলেছে। আগামী ৩ দিনে তাপমাত্রা আরও কিছুটা কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা বলেন, 'এই ওয়েভেই শৈত্যপ্রবাহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আসতে পারে। তবে ঢাকায় আসবে কি না- এটা বলা যাবে না। দেশের উত্তরাঞ্চলে আসার সম্ভাবনা আছে। আবার মাসের শেষের দিকে আরেকটি শৈত্যপ্রবাহের সম্ভাবনা আছে।'
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সকালের বুলেটিনের তথ্যানুযায়ী, দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নথিবদ্ধ করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গা ও গোপালগঞ্জে; ১০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃহস্পতিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে ২৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তথ্যানুযায়ী, আগামী ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে এবং আজ সকাল পর্যন্ত দেশের উত্তর-উত্তর পূর্বাংশের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা আর অন্যান্য এলাকায় হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে।
অন্যদিকে দক্ষিণপশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও আশপাশের এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপটি সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
সংস্থাটি বৃহস্পতিবার জানায়, সুস্পষ্ট লঘুচাপটি বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের শ্রীলঙ্কা উপকূলে অবস্থান করছে। এর বর্ধিত অংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। আর উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয় বিহার ও এর আশপাশ পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে।
শাহনাজ সুলতানা বলেন, 'সাগরে অবস্থানরত লঘুচাপটি সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়ে ভারতের তামিল নাডুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই।'