শনিবার, ০৩ মে ২০২৫, ১৯ বৈশাখ ১৪৩২

প্রযুক্তি খাতে সংস্কারের অভাবে সাইবার ঝুঁকিতে দেশ

সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের পরামর্শ প্রযুক্তি বিষয়ক নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন
গাফফার খান চৌধুরী
  ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
প্রযুক্তি খাতে সংস্কারের অভাবে সাইবার ঝুঁকিতে দেশ

প্রযুক্তিখাতে সংস্কার জরুরি। অন্যথায় বড় ধরনের সাইবার ঝুঁকিতে পড়তে পারে দেশ। চলমান পরিস্থিতিতে যেকোনো সময় প্রযুক্তিখাতে ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের বড় অঘটন। হ্যাক হয়ে যেতে পারে সরকারি বিভিন্ন ওয়েবসাইট। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রযুক্তিখাত সংস্কার না হওয়া, নিয়মিত সাইবার মনিটরিং না করা এবং অডিট না হওয়ার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন প্রযুক্তিবিদরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জুলাই বিপস্নবের সময় রিফর্ম বিডি ডট ২০২৪ নামে একটি ওয়েবসাইট খোলা হয়েছিল। সেখানে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর এবং দপ্তরের নানা তথ্য ছিল। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তাসহ সংশ্নিষ্টদের ব্যক্তিগত তথ্যও ছিল। যদিও সেই ওয়েবসাইটটির বর্তমানে কোন অস্তিত্ব নেই। ওই সময় ওয়েবসাইটে থাকা তথ্য পরবর্তীতে সরিয়ে নিয়েছেন ওয়েবসাইটের সঙ্গে জড়িতরা। এসব তথ্য বর্তমানে অনেকের কাছেই আছে। এমনকি সাধারণ মানুষের কাছেও চলে গেছে এসব তথ্য। এছাড়া হ্যাকারদের কাছেও আছে। ওইসব তথ্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর থেকে সংগ্রহ করেছিলেন বা হাতিয়ে নিয়েছিলেন ওয়েবসাইটটির অ্যাডমিনরা।

একাধিক প্রযুক্তিবিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের ওয়েবসাইটে হানা বা আক্রমণ করা হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। আক্রমণ করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে,

সাইবার সিকিউরিটি সিস্টেম ভেঙে তথ্য চুরি করা। অধিকাংশ সময়ই হ্যাকাররা সফল হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে সফল হচ্ছে না। হ্যাকারদের তথ্য চুরির সফলতার হার সবচেয়ে বেশি।

কারণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে থাকা প্রযু্ি‌ক্তখাতকে সংস্কারের আওতায় আনা হয়নি। এমনকি সংস্কার করা হয়নি। ঠিক সেই সুযোগটিকেই কাজে লাগাচ্ছে হ্যাকাররা। অনেকেরই কর্মস্থল পরিবর্তন হওয়ায় প্রযুক্তিখাতে দুর্বলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরেই সরকারি দপ্তরগুলোর প্রযুক্তিখাত নিয়মিত মনিটরিং হচ্ছে না। এছাড়া সাইবার অডিট না হওয়ার কারণে প্রযুক্তিখাতের কোথায় কোথায় দুর্বলতা আছে, তা জানা যাচ্ছে না বা চিহ্নিত হচ্ছে। ঠিক সেই সুযোগটিকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে হ্যাকাররা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওয়েবসাইটে কাজ করা তালিকাভুক্ত একজন প্রযুক্তিবিদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছে থাকা ৩২ লাখ পরিবারের তথ্য চুরি হয়ে গেছে। চুরি বলতে, তথ্য কপি করে নিয়ে গেছে হ্যাকাররা। এছাড়া পুলিশ সদর দপ্তরে ৭২ লাখ বিশেষ নাগরিকের পুরো পরিবার সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। সবমিলিয়ে ১ কোটি ৪ লাখ পরিবারের তথ্য চুরি বা কপি করে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে হ্যাকাররা। তথ্যগুলো আবেদন সার্ভার থেকে কপি বা চুরি হয়ে গেছে।

তিনি আরও জানান, তথ্য স্থানান্তর, পোস্টিং বা আপডেট করা এবং পস্নাগিং সিস্টেমের দুর্বলতার কারণে প্রচুর তথ্য চুরির ঘটনাগুলো ঘটেছে। নির্বাচন কমিশন থেকেও অনেক তথ্য চুরি বা কপি করে নিয়েছে হ্যাকাররা। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুই কোটি ১৪ লাখ সদস্যের তথ্য চুরি বা কপি হয়ে গেছে। এসব তথ্য চুরি হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পিআইএস (পার্সোনাল ইনফরমেশন সার্ভার) থেকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মূল সার্ভার থেকেই তথ্যগুলো চুরি হয়েছে।

ওই প্রযু্ি‌ক্তবিদ বলছেন, এসব তথ্য এখন হ্যাকারদের কাছে। চুরি করা তথ্য হ্যাকররা কি কাজে লাগাবে সেটি এখনও দৃশ্যমান হয়নি। তবে সাধারণত হ্যাকাররা কোন সৎ উদ্দেশ্যে তথ্য চুরি করে না। এটি হ্যাকারদের ধর্ম। হ্যাকার একটি নেগেটিভ শব্দ। যারা ভাল কাজের জন্য তথ্য নয় বা চুরি করা তথ্য হ্যাকারদের কাছ থেকে হ্যাক করে দেশ বা মানুষের স্বার্থে ফিরিয়ে আনেন তাদেরকে ইথিক্যাল হ্যাকার বলা হয়। অর্থাৎ তারা ভালো হ্যাকার। তাদের উদ্দেশ্য সৎ।

এসব বিষয়ে অপ্টাগন লিমিটেড নামের প্রযু্ি‌ক্ত কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রযু্ি‌্‌ক্তবিদ মো. হাসান শাহরিয়ার ফাহিম যায়যায়দিনকে বলেন, তথ্য ফাঁস হওয়ার অন্যতম কারণ নিম্নমানের ওয়েবসাইট। এছাড়াও সরকারি দপ্তরের অসাধু কর্মকর্তারাও অনেক সময় ব্যক্তিগত স্বার্থে বা অসৎ উদ্দেশ্যে তথ্য ফাঁসে সহায়তা করে থাকেন। আবার তাদের প্রযুক্তি সম্পর্কিত যথাযথ জ্ঞান না থাকার কারণেও তথ্য ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ সরকারি অফিসেই সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জোনভিত্তিক ওয়াইফাই ব্যবস্থা চালু আছে। অনেক কর্মকর্তা ওইসব ওয়াইফাইয়ের পাসওয়ার্ড না বুঝেই পরিচিত কাউকে দিয়ে দিচ্ছেন।

তিনি বলছেন, এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ যিনি পাসওয়ার্ড নিয়ে তার মোবাইলে বা ব্যক্তিগত কম্পিউটারে বা ল্যাপটপে ব্যবহার করছেন, তার ওইসব ডিভাইস হ্যাক করে অনায়াসেই অফিসের পাসওয়ার্ড পেয়ে যাচ্ছে হ্যাকাররা। আর সেই পাসওয়ার্ড দিয়েই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তথ্য ফাঁস চুরি করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এটি তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার একটি বড় সম্ভবনার জায়গা। এভাবেই অনেক দপ্তরের তথ্য ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। দেশের অধিকাংশ সরকারি দপ্তরের সাইবার নিরাপত্তা সিস্টেমে যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। সেই সুযোগটিকেও কাজে লাগায় হ্যাকাররা।

তিনি বলেন, বর্তমানে সরকারের অধিকাংশ দপ্তরের প্রযুক্তিখাতে কোন ধরনের সংস্কার করা হয়নি। প্রযু্ি‌ক্তখাতকে অবশ্যই সংস্কার করতে হবে। শক্তিশালী সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হলে নিয়মিত মনিটরিং ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে। সম্প্রতি সরকারি প্রযুক্তিখাতগুলোতে নিয়মিত মনিটরিং হচ্ছে না। এছাড়া নিয়মানুযায়ী প্রযু্ি‌ক্তখাতকে সবসময়ই গভীর তদন্তের মধ্যে রাখতে হয়। এতে করে কোথা থেকে তথ্য চুরি বা লিক হচ্ছে, সেটি শনাক্ত করা সম্ভব হয়। দুর্বলতা শনাক্ত করা সম্ভব না হলে, স্বাভাবিক কারণেই হ্যাকাররা তথ্য চুরির সুযোগ নিবে। যাকে সাইবার অডিট বলা হয়। প্রযুক্তিখাতে নিয়মিত অডিট অব্যাহত রাখতে হবে। অন্যথায় সাইবার ঝুঁকি থেকেই যাবে। বর্তমান প্রযুক্তিখাত সংস্কার না হওয়ার কারণে দেশ বড় ধরনের সাইবার ঝুঁকির মধ্যে আছে। দ্রম্নত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

প্রসঙ্গত, দেশি-বিদেশি হ্যাকারদের কারণে পতিত শেখ হাসিনা সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন অনেকটাই পুরণ হয়নি। যেসব খাত প্রযু্ি‌ক্তর আওতায় আনা হয়েছে, তাতেও অনেক বেগ পেতে হয়েছে। তারপরেও ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার হ্যাক করে রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটে। এরপর বরিশাল ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাক হয়। চুরি হয় হাজার হাজার মানুষের ব্যক্তিগত ও সরকারি তথ্য। গত বছর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ওয়েবসাইট আংশিক হ্যাক হয়ে তথ্য চুরির ঘটনা ঘটে। মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের ওয়েবসাইট হুবহু নকল বানিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে শেখ হাসিনা সরকারের সময়ই।

উলেস্নখ্য, গত বছরের ৬ জুলাই শেখ হাসিনা সরকারের আমলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সংবাদমাধ্যম টেকক্রাঞ্চে বাংলাদেশের সরকারি একটি ওয়েবসাইট থেকে লাখ লাখ নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। এরপর গত বছরের ১৪ আগস্ট থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র বিভাগের সার্ভার অনেক দিন বন্ধ ছিল। দেশের প্রায় ১৭ কোটি নাগরিকের মধ্যে ১২ কোটি নাগরিকের তথ্য রয়েছে ইসিতে। যার মধ্যে মোট ভোটারের সংখ্যা ১১ কোটি ৯১ লাখ ৫১ হাজার ৪৪০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৭২৪ জন। নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৭ লাখ ৪ হাজার ৮৭৯ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৮৩৭ জন। যদিও তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের নির্বাচন কমিশন কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল, সবার তথ্যই সুরক্ষিত আছে।

প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ রয়েছে ১৭১টি পার্টনার সার্ভিস অর্গানাইজেশন। যার অধিকাংশই সরকারি-আধা সরকারি ও শায়ত্তশাসিত। এসব অর্গানাইজেশন নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সেবা নিতে যাওয়া ভোটাদের তথ্য যাচাই করে থাকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে