বছরের শেষভাগে এসে বায়ুদূষণে প্রায়ই শীর্ষে উঠে আসছে রাজধানী ঢাকার নাম। মঙ্গলবার সকালেও ঢাকার বায়ুর মান ছিল 'খুব অস্বাস্থ্যকর'। বিশ্বের ১২৬টি শহরের মধ্যে এদিন ঢাকার অবস্থান ছিল তৃতীয়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ২০১৬ সালের পর ২০২৩ সালে ঢাকার বায়ুমান সবচেয়ে খারাপ ছিল। ২০২৪ সালেও পরিস্থিতি একটুও বদলায়নি। তাদের মতে, বছরে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে বায়ুদূষণ। আর সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবে কিনা- এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। এদিকে, বায়ুদূষণ রাতারাতি কমানো সম্ভব নয় উলেস্নখ করে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, সরকার বায়ুদূষণের কারণে সৃষ্ট জনদুর্ভোগ কমাতে কাজ করছে।
অন্যদিকে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণে বাড়ছে অসংক্রামক রোগ। এসব রোগে মৃতু্যর হারও বাড়ছে। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেই বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারছে না কোনো পক্ষ। ফলে বায়ুদূষণ রোধের বিষয়টি সেই তিমিরেই থেকে যাচ্ছে।
মঙ্গলবার সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের মানসূচকে ঢাকার বায়ুর মান ছিল ২৩২। বায়ুর এই মানকে 'খুব অস্বাস্থ্যকর' হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এদিন ২৮৬ স্কোর নিয়ে বায়ুদূষণে শীর্ষে ছিল ভারতের দিলিস্ন। এরপর ইরাকের বাগদাদ। শহরটির স্কোর ২৬৭।
তথ্য অনুযায়ী, এদিন ঢাকার গুলশান-২ এলাকার স্কোর ২৮৭, ইস্টার্ন হাউজিং-২ এলাকার স্কোর ২৮২) ও গুলশান লেক পার্ক এলাকার বায়ুর মানের স্কোর ছিল ২৬৮।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উপাদান হলো বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি। ঢাকার বাতাসে এর উপস্থিতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিস্নউএইচও) মানমাত্রার চেয়ে ৩১ দশমিক ৪ গুণ বেশি। আজ বায়ুদূষণের যে অবস্থা, তা থেকে রক্ষা পেতে আইকিউএয়ারের পরামর্শ, ঘরের বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। খোলা স্থানে ব্যায়াম করা যাবে না। আরও একটি পরামর্শ, ঘরের জানালা বন্ধ রাখতে হবে।
জলবায়ু বিশ্লেষকদের মতে, ভৌগোলিক কারণে প্রতি বছর শীতের সময় ঢাকার বায়ুদূষণ বাড়লেও এবার শীত মৌসুম শুরুর বেশ আগে থেকেই রাজধানীর বাতাসে দূষণের পরিমাণ বাড়ছিল। শীতে এসে তা আরও বিস্তার ঘটেছে। যে কারণে দূষণের দিক থেকে প্রায়ই শীর্ষে উঠে আসছে ঢাকার নাম। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের সূচকে চলতি বছরে ঢাকা একাধিকবার ৩০০'র বেশি একিউআই স্কোর নিয়ে সর্বোচ্চ দূষিতের তালিকায় নাম লিখিয়েছে।
এ বিষয়ে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ডিন মি. মজুমদার সম্প্রতি একটি সংবাদ মাধ্যমকে জানান, গত ৮ বছরের তুলনায় ২০২৩ সালে ১০ ভাগেরও বেশি বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে যা একটা বড় শঙ্কার বিষয়।
তবে বারবার দূষণের তালিকায় ঢাকার শীর্ষে চলে আসার পেছনে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণকে চিহ্নিত করেছেন পরিবেশবাদীরা। তাদের মতে, বড় বড় প্রকল্পের নির্মাণ কাজ চলায় বায়ুদূষণ বাড়ছে। যে কোনো ধরনের নির্মাণ কাজের সময় বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে সেসব নিয়ম পালনের তোয়াক্কা করতে দেখা যায় না।
রাস্তা ও ভবন নির্মাণ বা মেরামতের সময় ধুলাবালি যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে না যায় সেজন্য নির্মাণ স্থানে যথাযথ অস্থায়ী ছাউনি বা বেষ্টনী দেয়ার নিয়ম রয়েছে। সেইসঙ্গে, বেষ্টনীর ভেতর ও বাইরে নির্মাণ সামগ্রী (মাটি, বালি, রড, সিমেন্ট ইত্যাদি) যথাযথভাবে ঢেকে রাখা এবং দিনে কমপক্ষে দুইবার স্প্রে করে পানি ছিটানোর কথা বলা আছে পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনায়। এছাড়া নির্মাণাধীন রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখে বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা করা, দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত করা এবং নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে পরিবহণ করার কথাও বলে অধিদপ্তর। তবে এসব নিয়ম কাগজে-কলমে থাকার মাঝেই সীমাবদ্ধ বলে অভিযোগ তাদের।
এ বিষয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা ১৯ ডিসেম্বও সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান একটি অনুষ্ঠানে বলেন, 'সমন্বয়হীনতা যেন না থাকে, সেজন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করে দেওয়া হয়েছে। বায়ুদূষণে ঢাকা শীর্ষে এটা এই বছরই প্রথম শুনেননি। এটা গত ১২ বছর ধরে শুনে আসছেন, ৬-৭ বছর ধরে শীর্ষে শুনছেন। বায়ু দূষণ নিয়ে ২০১৫ সাল থেকে আদালতে লড়াই করেছি, এখন সরকারে এসে কাজ শুরু করার সুযোগ পেয়েছি। ২০১৫ সালে আদালত বলেছিলেন, একটি এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট পস্ন্যান দিতে। এত বছর কিছু হয়নি। এখন এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট পস্ন্যান ফাইনাল হয়েছে। যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, তারা জনদুর্ভোগ কমাতে কাজ করবে। বায়ু দূষণ কমানো এক মাস, দুই মাস, এক বছরের ব্যাপার নয়। আমরা এখানে মিথ্যা কোনো প্রতিশ্রুতি আপনাদের দিতে পারবো না। ধুলো, গাড়ির কালো ধোঁয়া, ইটভাটা, স্টিল মিল থেকে যে দূষণটি হচ্ছে, সেগুলো কমিয়ে জনদুর্ভোগ কিছুটা কমানোর চেষ্টা করতে পারি। সেটার জন্য টাস্কফোর্সকে কয়েকটি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।'
বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস হিসেবে ইটভাটাকে দায়ী করেন বিশেষজ্ঞরা। দূষণবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ক্যাপস-এর 'দেশব্যাপী ৬৪ জেলার বায়ুদূষণ সমীক্ষা ২০২১' অনুযায়ী, ঢাকার আশপাশের প্রায় ১২শ' ইটভাটা, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্প কারখানা আছে, যেগুলো দূষণের অন্যতম কারণ। ইটভাটাগুলো শুষ্ক মৌসুমে চলমান থাকে। শীতকালে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কম থাকার ফলে এই সময়ে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায়। ঘটে বায়ুদূষণ। অথচ বায়ুদূষণ হ্রাসের লক্ষ্যে 'ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯)' শীর্ষক আইন গৃহীত হলেও আইনের তেমন প্রয়োগ নেই।
এ ব্যাপারে ওই অনুষ্ঠানে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, 'আশুলিয়া থেকে বেশিরভাগ ইট ভাটার ধোঁয়া আসে। আশুলিয়াকে নো ব্রিক ফিলড জোন ঘোষণা করা যায় কি-না ভাবা হচ্ছে।'
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর মো. হাদিউজ্জামান একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, 'নির্মাণ স্থলে পানি ব্যবহার করার জন্য টাকা ধার্য থাকলেও ঠিকাদাররা মুনাফা করতে গিয়ে পরিবেশের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে ফেলছেন। যার কারণে আমরা সবাই বিপদের মাঝে আছি।'
বিশেষজ্ঞরা ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য সিটি করপোরেশনকে দুষছেন। কারণ সড়কে নিয়মিত পানি ছিটায় না সিটি করপোরেশন। আবার এ বিষয়টির সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে দ্বিমত পোষণ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুটো স্প্রে ক্যানন এবং দশটি গাড়ির মাধ্যমে মহাসড়কে নিয়মিত পানি ছিটাচ্ছে ডিএনসিসি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণের আরেকটি অন্যতম উৎস ফিটনেসবিহীন গাড়ি। ঢাকা শহরে যে পরিমাণ বাস চলে, তার সত্তর শতাংশেরই আয়ুষ্কাল শেষ। ফলে এর মাধ্যমেও ঘটছে বায়ুদূষণ। কারণ কোনো যানবাহনের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেলে সেগুলো ঠিকভাবে জ্বালানি পোড়াতে পারে না এবং তখন সেগুলোর ধোঁয়ার সাথে ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্গত হয়।
ক্যাপস-এর গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার যেসব এলাকায় বর্জ্য পোড়ানো হয়, সেসব এলাকাতে বায়ুদূষণ বেশি ঘটে। ময়লার স্তূপ যেখানে থাকে সেখানে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। অনেক সময় এই মিথেন গ্যাসের দুর্গন্ধ থেকে বাঁচার জন্য পরিচ্ছন্ন কর্মীরা আগুন জ্বালায়। শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার অন্তত ৫০টি স্থানে পোড়ানো বর্জ্য থেকেও বায়ুদূষণ ঘটছে।
এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে ভারতের অংশ থেকে বাংলাদেশের দিকে বায়ু প্রবাহিত হয়। ফলে দিলিস্নর বায়ুদূষণ চরম আকার ধারণ করলে কয়েকদিনের মধ্যে বাংলাদেশেও বায়ুদূষণের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। আবহাওয়াবিদরা এই দূষণকে বলেন 'রিজিওনাল এয়ার পলিউশন'।
নগরীর দূষণ নিয়ে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, রোববার রাতে টানা প্রায় আট ঘণ্টা ঢাকার বায়ুর স্কোর ছিল ৩০০-এর বেশি। ঢাকার বায়ুর মান যে কতটা নাজুক, এই স্কোর তা তুলে ধরছে।'
নগরীর দূষণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অন্তত তিনটি কাজ জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'নগরীতে যে কোনো ধরনের বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ করতে হবে, নির্মাণকাজ চলার সময় অবশ্যই প্রয়োজনীয় পানি দিতে হবে এবং দূষণকারী যানবাহনের চলাচল বন্ধ করতে হবে।'
পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনেও ঢাকার বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে এসব উৎসকে দায়ী করা হয়েছে। তবে ঢাকার বায়ুর মান উন্নয়নে বিভিন্ন সময় সিটি করপোরেশনকে পানি ছিটিয়ে ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে। অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান এবং রাস্তার ওপর নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রাখার জন্য অভিযান চালিয়ে জরিমানাও করা হয়েছে। বাস্তবতা হলো, এরপরও পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটেনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন আন্দোলনের মতে, ঢাকায় বায়ুদূষণের পরিমাণ বছরে ১০ শতাংশ করে বাড়ছে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বায়ুদূষণের ফলে স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ, পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যানসার এবং শ্বাসযন্ত্রে তীব্র সংক্রমণের ফলে দেশে মৃতু্যহার বাড়ছে।
জানা যায়, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কমিটিও রয়েছে সরকারের। এই কমিটি বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবে। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় করবে। এই কমিটি সভা করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়েছে। কিন্তু এরপরও বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থান সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।