রমজান মাসে ছোলা, ডাল, চিনি, খেজুর ও ভোজ্যতেলসহ বেশকিছু ভোগ্যপণ্যের চাহিদা থাকে অনেক বেশি। এসব পণ্যের অধিকাংশই আমদানি করতে হয়, যার সিংহভাগ আসে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে। তাই প্রতি বছর রমজানের দুই থেকে তিনমাস আগে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যস্ততা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। জাহাজ ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। আমদানি কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় ইয়ার্ডে পণ্যের স্থান সংকুলান করা কঠিন হয়ে পড়ে। জেটিতে ভেড়ার আশায় অনেক জাহাজ পণ্য খালাসের অপেক্ষায় দিনের পর দিন বহির্নোঙরে অপেক্ষা করে।
কিন্তু এবার বন্দরে এখনও সেই দৃশ্যের দেখা মেলেনি। জেটিতে ভিড়বে বলে বহির্নোঙরে আগের মত অপেক্ষামান জাহাজের ভিড়ও বাড়তে শুরু করেনি। ইয়ার্ডেও রোজার আমদানিকৃত পণ্যের গাদাগাদি নেই। ডিপোগুলোতেও নেই রোজার পণ্য খালাসের ব্যস্ততা।
আমদানিকারকরা বলছেন, বিশ্ববাজার স্থিতিশীল। কিন্তু সংকট কিছুটা কাটলেও ডলারের দাম নিয়ে দুঃশ্চিন্তা রয়েছে। কারণ ডলারের দাম বাড়লে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে। তাই রোজার পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা বুঝে-শুনে পা ফেলার চেষ্টা করছেন। যদিও রোজার পণ্যের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে। তবে যথেষ্ট এলসি খোলা হলেও সময়মত রোজার পণ্য পুরোটা আমদানি হবে তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ঋণপত্র খোলা মানেই আমদানি নয়। ঋণপত্রের বিপরীতে পণ্য শেষ পর্যন্ত আমদানি হয় কি না, সেদিকে নজর রাখতে হবে। তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের বাজারে গুটিকয় বড় ব্যবসায়ী বেশি আমদানি ও সরবরাহ করেন। তাঁদের কারও সরবরাহে বিঘ্ন হলেই বাজারে অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা থাকে।
গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার ডলারের দাম বেশি এবং বিশ্ববাজার চড়া। ফলে পণ্যের আমদানি ব্যয় কিছুটা বেশি পড়বে। অন্য কোনো কারণে যাতে দাম না বাড়ে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এসব ব্যাপারে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ জরুরি।
এদিকে আমদানিকারকরা বলছেন, রোজার মাসে যেসব পণ্য বেশি চাহিদা থাকে, এ ধরণের পণ্যের পর্যাপ্ত এলসি খোলা হলেও এরমধ্যে বেশ কয়েকটি আইটেমের আগে থেকেই পর্যাপ্ত ঘাটতি রয়েছে। তাই সম্প্রতি খোলা সিংহভাগ ঋণপত্রের মাল আমদানি করা হলেও বাজারে সংকট থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে এসব পণ্যের দাম কিছুটা বেড়েও যেতে পারে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে বছরে চিনির চাহিদা ২০ থেকে ২২ লাখ টন। সে হিসাবে ছয় মাসে লাগে ১০ থেকে ১১ লাখ টন। কিন্তু গত ছয় মাসে দেশে চিনি আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৬৪ হাজার টন। অথচ শুধুমাত্র রোজার সময়ই ৩ লাখ টন চিনি লাগে।
দেশে ছোলার বার্ষিক চাহিদা ২ লাখ টন। যার অর্ধেক প্রয়োজন হয় পবিত্র রমজানে। ছয় মাসে ১ লাখ টন ছোলার চাহিদার বিপরীতে আমদানি হয়েছে মাত্র ৪৮ হাজার টন। মসুর ডালের চাহিদা সাড়ে ৩ লাখ টন, যার মধ্যে রমজান মাসে চাহিদা থাকে ১ লাখ টন। গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জানুয়ারির ৫ তারিখ পর্যন্ত দেশে মসুর ডাল এসেছে ২ লাখ ৫১ হাজার টন।
এ ছাড়া দেশে সারা বছরে যত খেজুর লাগে, তার অর্ধেক চাহিদা থাকে রমজান মাসে। সারা বছর খেজুরের চাহিদা ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টন। এরমধ্যে পবিত্র রমজানে খেজুরের চাহিদা ৬০ হাজার টন। তবে গত জুলাই থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশে খেজুর আমদানি হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৮৮৩ টন।
আমদানির এ চিত্র পর্যালোচনায় বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, ঋণপত্র খোলার হিসাব সন্তোষজনক হলেও রমজানে বেশি চাহিদা থাকা পণ্যগুলোর বাজার কতটা স্থিতিশীল থাকবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এছাড়া বাজার কারসাজি ও সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা কতটা থামানো যাবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকছে।
ভোজ্যতেল, ছোলা, মসুর ও মটর ডালের বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টি কে গ্রম্নপের পরিচালক শফিউল আতহার বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তি দাম, ডলারের উচ্চ মূল্য ও ডলার-সংকটে গত ছয় মাসে অনেকে পণ্য আমদানি করতে পারেননি। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতাও বড় একটি কারণ। ফলে অনেক পণ্যের আমদানি কমেছে। তবে গত ডিসেম্বর থেকে পণ্য আমদানি বাড়ছে। কারণ, এ মুহূর্তে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। যেসব ঋণপত্র খোলা হয়েছে, সেগুলোর বিপরীতে পণ্য যদি যথাসময়ে আমদানি হয়, রোজার মাসে পণ্যের সংকট হবে না। তবে ঋণপত্র অনুযায়ী পণ্য আমদানি হবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার খেজুর আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে ৮৬ হাজার টনের। গত বছর একই সময়ে ৪৮ হাজার টন খেজুরের ঋণপত্র খোলা হয়েছিল, অর্থাৎ খেজুরের ঋণপত্র খোলার হার বেড়েছে ৭৯ শতাংশ। এবার ১ লাখ ৮৯ হাজার টন ছোলার ঋণপত্র খোলা হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেশি। মসুর ডালের ঋণপত্র খোলার হার ২১ শতাংশ বেড়ে ২ লাখ ২ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। অপরিশোধিত চিনি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার হার শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ বেড়ে ৮ লাখ ৬ হাজার ৭১৯ টনে দাঁড়িয়েছে।
তবে ঋণপত্র খোলার হার বাড়লেও খোদ আমদানিকারকরাও শেষ পর্যন্ত কী পরিমাণ পণ্য আমদানি করতে পারবেন তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন আমদানিকারকের সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে তাদের যথেষ্ট সংশয়ে থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।
খেজুরের আমদানিকারক মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী হাজি এনায়েতুলস্নাহ বলেন, অতিরিক্ত শুল্কের কারণে এবার খেজুরের আমদানি প্রায় বন্ধ ছিল। তবে গত ২১ নভেম্বর শুল্কছাড়ের পর অনেকে ঋণপত্র খুলছে। তারপরও ৪১ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। তার চেয়ে বড় বিষয় হলো ট্যারিফ ভ্যালু বাস্তবে কেনা দামের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে খেজুরের আমদানি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
এদিকে রমজানে দাম সহনীয় রাখতে খেজুর আমদানির ওপর বিদ্যমান কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ হতে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ এবং বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থাৎ মোট করভার ৬৩ দশমিক ৬০ শতাংশ হতে কমিয়ে ৩৮ দশমিক ৭০ শতাংশ করা হয়েছে। এই সুবিধা ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
অথচ শুল্ক কমানোর পরও আমদানি বাড়লেও দাম কমেনি। বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে প্রতি কেজি দাবাস খেজুর ৪৮০ টাকা, খুরমা খেজুর ৩৮০ টাকা, আজওয়া খেজুর ১ হাজার ১০০ টাকা, জাহিদি খেজুর ২৮০ টাকা, বরই খেজুর ৪৪০ টাকা, মরিয়ম খেজুর ১ হাজার ৪৫০ টাকা ও মেডজুল খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ টাকায়।
বাজারের যখন এ পরিস্থিতি তখন ভোক্তারা বলছেন, শুধু আমদানি শুল্ক হ্রাস বা বিদেশ থেকে পণ্য আনলেই হবে না, দাম নিয়ন্ত্রণে করতে কঠোর বাজার মনিটরিংও দরকার।
\হ
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ক্যাব বলছে, ব্যবসায়ীদের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে কাজে আসবে না কোনো উদ্যোগই। ক্যাব সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম। এটি গত সরকারের সময় থেকেই বাড়তি। সরকার পতনের পর মাঝে এক সপ্তাহ দাম কমলেও এখন আবার সেটি চড়া। কারণ সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীরা পোশাক বদলেছে, কিন্তু চরিত্র বদলায়নি। তারা আগের মতোই কারসাজি করে যাচ্ছে।
রোজায় পণ্যের দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার দাম কমানোর জন্য পণ্য আমদানি ও শুল্ক ছাড় দিচ্ছে। কিন্তু বাজারে পর্যাপ্ত মনিটরিং হচ্ছে না। প্রতিবারই এরকম হয়ে থাকে। সরকার নানা পদক্ষেপ নেয় দাম কমানোর, তবে মনিটরিংয়ের জায়গায় ঘাটতি থেকে যায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে পণ্য আমদানি থেকে শুরু করে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত মনিটরিং করতে হবে। না হলে সুফল মিলবে না।
এদিকে আসছে রমজান মাসে অতি প্রয়োজনীয় ১১টি খাদ্যপণ্য আমদানিতে বিলম্বে বিল পরিশোধের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পণ্যগুলো হলো-চাল, গম, পেঁয়াজ, ডাল, ভোজ্য তেল, চিনি, ডিম, ছোলা, মটর, মসলা এবং খেজুর। এসব পণ্য ৯০ দিনের সাপস্নাইয়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আমদানি করা যাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, আমদানি লেনদেন সহজ করতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এবং চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বলবত থাকবে।
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, ডলার সংকটে সাম্প্রতিক সময়ে এসব পণ্যের এলসি খোলা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের এলসি খুলতে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এমনিতেই দেশের সার্বিক আমদানি কমে গেছে। কিন্তু আগামী রোজায় প্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।