রোববার, ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

বাড়িভাড়ার বাড়তি চাপে চিড়েচ্যাপ্টা নিম্নমধ্যবিত্ত

যাযাদি রিপোর্ট
  ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
বাড়িভাড়ার বাড়তি চাপে চিড়েচ্যাপ্টা নিম্নমধ্যবিত্ত
ঢাকা শহরের একটি আবাসিক এলাকা -ফাইল ছবি

দেশে মূল্যস্ফীতি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। চিকিৎসা, শিক্ষা, যাতায়াত ভাড়াসহ নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে তিনবেলা পুষ্টিকর খাবার জোটাতেই হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এর সঙ্গে বছরের শুরুতেই বাসাভাড়া বাড়ানোর হিড়িক নিম্নমধ্যবিত্তের 'গোদের উপর বিষফোঁড়া' হয়ে দেখা দিয়েছে।

রাজধানীসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, অল্প আয়ের মানুষের ৪-৫ হাজার টাকার আধা-পাকা বাড়িরও ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার সাধারণ মানের বাসাভাড়া ১ থেকে ২ হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে। একটু ভালো মানের ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকার বাড়িভাড়া এক ধাক্কায় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর কথা জানা গেছে।

ফ্ল্যাটভাড়া, বিক্রি বা লিজের ব্যাপারে অন্যতম সন্ধানদাতা প্রতিষ্ঠান বিপ্রপার্টির তথ্য অনুসারে, ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক, ধানমন্ডি, বনশ্রী ও রামপুরায় বাড়িভাড়া বেড়েছে ১৪ থেকে ২০ শতাংশ। বাড্ডা, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় বেড়েছে ৭ থেকে ৮ শতাংশ।

সাধারণ মানুষের গলাচেপে ধরে এভাবে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অমানবিক জানিয়ে কনজু্যমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এ দেশে যারা বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দিচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই বর্তমান ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ ও ব্যবসায়ীরা। এদের বেশিরভাগই ঘুষ বা অনৈতিক উপায়ে আয় করে একাধিক বাড়ি বানিয়ে ভাড়া তুলছেন। নিজের পকেট ভারী করাই অন্যতম উদ্দেশ্য। ভাড়া বাড়ানোয় ভাড়াটিয়ারা কতটা ভোগান্তিতে পড়ছেন, তা নিয়ে চিন্তা করেন না। এসব বাড়ির মালিক বেশিরভাগ কর ফাঁকি দেন। এদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ আইনি জটিলতা ও ঝামেলা হবে এমন আশঙ্কায় এসব প্রভাবশালী বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে যান না বললেই চলে।

তিনি বলেন, 'এর বাইরেও কিছু মানুষ অল্প অল্প করে সঞ্চয় করে বাড়ি বা ফ্ল্যাট বানিয়ে ভাড়া দেন। এদের সংখ্যা অনেক কম। খোঁজ নিয়ে দেখবেন এসব ব্যক্তি সাধারণ ভাড়াটিয়ার ওপর তুলনামূলক কম চাপ দেন।'

রামপুরা এলাকায় টিভি রোডের ১২শ' বর্গফুটের তিন রুমের ফ্ল্যাটের ভাড়া থাকেন বেসরকারি কর্মকর্তা সুজন মাহমুদ। দুই সন্তান স্ত্রীসহ গত বছরের মার্চে এই ফ্লাটে উঠেন তিনি। গত বছরের এ ফ্লাটের ভাড়া ছিল ১৮ হাজার টাকা। ৩ হাজার বেড়ে চলতি জানুয়ারি মাস থেকে ২১ হাজার টাকার কথা বলে দিয়েছেন বাড়িওয়ালা মান্নান

সরকার।

সুজন মাহমুদ এ প্রতিবেদককে জানান, বেতনের অর্ধেক টাকায় চলে যায় বাড়ি ভাড়ায়। এর মধ্যে আবার নতুন করে বাড়ানো হলো বাড়িভাড়া। তাই তিনি কিছুটা কম ভাড়ায় দুই রুমের নতুন করে বাসা খুঁজছেন। সুবিধামতো বাসা না পেলে আগের বাসার এক রুমে সাবলেট দেবেন বলে চিন্তাভাবনা করছেন।

মোহাম্মপুর বেড়িবাঁধ এলাকার বাসিন্দা নুরুল হক দীর্ঘ ৪ বছর ধরে থাকেন ৩ রুমের একটি ফ্ল্যাটে। গত ৪ বছরের ব্যবধানে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ১২ হাজার। ফলে, ১৭ হাজার টাকা ফ্ল্যাটের ভাড়া এখন ২৯ হাজার টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। নুরুল হকের ভাষ্য, নিত্যপণ্যেসহ সব ক্ষেত্রে খরচ বেড়েছে। তবে আয় বাড়েনি। এ পরিস্থিতিতে স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া ছাড়া সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।

মিরপুর-১৩ নম্বরের বিজয় রাকিন সিটিতে ২৪ হাজার টাকার ভাড়াবাড়িতে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন চাকারিজীবী রিয়াজ রহমান। ২৫ নভেম্বর তার ফ্ল্যাটের মালিক ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ভাড়া ১০ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৩৪ হাজার টাকা করার কথা জানিয়েছেন।

রিয়াজ রহমান বলেন, 'এই বছরের শুরুতে আমার বেতন ২ হাজার টাকা বেড়ে ৫৫ হাজার টাকা হয়েছে। এই বেতনে খাবার, ডাক্তার-ওষুধ, যাতায়াত, ছেলেমেয়ের পড়াসহ সংসারের খরচ করে ২৪ হাজার টাকা বাসাভাড়া দিতেই কষ্ট হয়ে যায়। অনেক সময় ধারদেনা করি। এর মধ্যে ১০ হাজার টাকা ভাড়া বাড়ানো অমানবিক।'

সরেজমিন রাকিন সিটিতে গিয়ে দেখা যায়, একই আকার ও মানের বাসারভাড়া বিভিন্ন রকম। কোনোটির ২৫ হাজার, কোনোটির ৩৫ হাজার বা ৪০ হাজার টাকাও চাওয়া হচ্ছে। কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে এ এলাকার বেশিরভাগ ফ্ল্যাটের মালিক ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে থাকেন। শুধু এ এলাকা নয়, রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে কোনো ভাড়াটিয়া বাড়তি ভাড়া দিতে সক্ষম না হলে নানা অজুহাতে নামিয়ে দেওয়া হয়। অনেক সময় হুমকি ধমকি দিয়েও বাসা ছাড়তে বাধ্য করা হয়।

রাজধানীর বাড্ডায় অসুস্থ শাশুড়ি ও এক মেয়ে নিয়ে ১৫ হাজার টাকার ভাড়াবাড়িতে থাকেন শামসুর নাহার। তিনি বলেন, 'স্বামী মারা গেছেন। আমি রঙের কারখানায় কাজ করি। কারখানা মেয়ের স্কুলের কাছে বলেই এখানে থাকি। গত বছর ভাড়া বাড়িয়েছে ১ হাজার টাকা। দুই বছর পর ভাড়া বাড়ানোর কথা থাকলেও এই বছর আবারও ১ হাজার টাকা বাড়ানোর কথা বলেছেন। এই এলাকায় বাড়িওয়ালার ছয়তলার দুটি বাড়ি। তার সব ফ্ল্যাটেই গড়ে ১/২ হাজার টাকা করে ভাড়া বাড়িয়েছেন। বাড়তি ভাড়া দিতে না পারলে বাসা ছেড়ে দিতে হবে।'

রাজধানীর উত্তরা, বনানী, গুলশান, মিরপুর, মোহাম্মপুর, বসিলা, ফার্মগেট, পল্টন, বাড্ডা, রামপুরা, মহানগর আবাসিক, মগবাজার, ইস্কাটন, বাংলামোটর, কাঁঠালবাগান ও পান্থপথ এলাকার ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জানুয়ারি মাস এলেই বেড়ে যায় বাড়িভাড়া। চলতি মাসের প্রথম থেকে ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দিয়েছে বাড়িওয়ালা। জানুয়ারি মাস থেকে বাড়তি এ ভাড়া আদায় করা হবে। এছাড়া, অনেক এলাকায় গত বছরের ডিসেম্বরে ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ রক্ষায় সরকারি ১৯৯১ সালে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন করে। আইন থাকলেও দেখভালের দায়িত্বে কোন মন্ত্রণালয় থাকবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা নেই। এছাড়া, আইনটি প্রয়োগে একজন 'নিয়ন্ত্রক' নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও গত ৩৪ বছরেও নিয়ন্ত্রকের দেখা নেই। আইন অনুসারে, প্রধান সড়কের পাশে, গলির তিনশ' ফুটের মধ্যে এবং গলির তিনশ' ফুটের বাইরের ভাড়া আলাদা আলাদা হওয়ার কথা উলেস্নখ আছে। আবাসিক, বাণিজ্যিক এবং শিল্পাঞ্চল এলাকায় বাড়ির হোল্ডিং নম্বর, নির্মাণের সময়, নির্মাণশৈলী, অবস্থানের শর্তের ওপর ভিত্তি করে ভাড়ার তালিকাও নির্ধারণ করার বিষয়টি রয়েছে। কোনো বাড়ির ভাড়া নির্ধারিত পয়েন্ট অতিক্রম করলে চুক্তিতে অন্যকিছু উলেস্নখ না থাকলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়যোগ্য হবে না বলে উলেস্নখ্য রয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ক্রমবর্ধমান বাড়িভাড়া নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে। চলমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এটি বাড়তি চাপ তৈরি করছে। এই বাড়তি খরচ কম আয়ের পরিবারগুলোর বোঝা দ্বিগুণ করে দেয়। এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজীম আল ইসলাম বলেন, বছরের শুরুতেই বিবেকহীনভাবে ভাড়া বাড়ানোর ঘটনা বেশি ঘটে। অনেক ভাড়াটিয়া আইনি জটিলতায় বাড়িওয়ালার স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেন না। অথচ বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী বাড়িওয়ালা যখন-তখন ভাড়া বাড়াতে পারবেন না। মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে আপসে ভাড়া ঠিক করতে হবে। দুই বছরের আগে বাড়ি ভাড়া বাড়ানো যাবে না।

আইন অনুযায়ী, 'বাড়িওয়ালা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য অতিরিক্ত আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ পর্যন্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিবার অপরাধের জন্য ওই অতিরিক্ত টাকার তিন গুণ দন্ডিত হবেন। বাড়িওয়ালা এক মাসের বেশি ভাড়া অগ্রিম হিসেবে নিতে পারবেন না। বাড়িভাড়া নিতে গেলে লিখিত চুক্তি করে নিতে হবে। বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াকে ভাড়া গ্রহণের লিখিত রসিদ প্রদানে বাধ্য থাকবেন। চুক্তি অনুযায়ী ভাড়া পরিশোধ করে থাকলে ভাড়াটিয়াকে হঠাৎ করে উচ্ছেদ করা যায় না। ভাড়াটিয়া প্রয়োজন মনে করলে আদালতের আশ্রয় নিতে পারবেন। আইনের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট এলাকায় একজন নিয়ন্ত্রক ও উপনিয়ন্ত্রক থাকবেন। তাদের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া আছে।'

তবে, আইনে যা-ই থাক না কেন, বাস্তবে যে তার প্রয়োগ নেই তা ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, 'ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে ভাড়াটিয়াদের চাপে ফেলার সুযোগ বাড়িওয়ালাদের আছে। কারণ দেশে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১ থাকলেও বাস্তবে এর তেমন প্রয়োগ নেই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে