বুধবার, ০৭ মে ২০২৫, ২৪ বৈশাখ ১৪৩২

সংস্কার ছোট পরিসরে না দীর্ঘ মেয়াদে সিদ্ধান্ত জনগণের

ক্লাউস শোয়াবের সঙ্গে বৈঠকে ড. ইউনূস
যাযাদি ডেস্ক
  ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
সংস্কার ছোট পরিসরে না দীর্ঘ মেয়াদে সিদ্ধান্ত জনগণের
ড. মুহাম্মদ ইউনূস সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম- ডবিস্নউইএফ-এর বার্ষিক সম্মেলনের ফাঁকে বৃহস্পতিবার ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়াবের সঙ্গে বৈঠক করেন - ফোকাস বাংলা

সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে আলোচনার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বিষয়টি জনগণের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, দেশের জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা ছোট পরিসরে না কি দীর্ঘ মেয়াদে সংস্কার চায়। সে অনুযায়ী নির্বাচন দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম- ডবিস্নউইএফ-এর বার্ষিক সম্মেলনের ফাঁকে ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়াবের সঙ্গে বৈঠকে মুহাম্মদ ইউনূস এ কথা বলেন।

বাংলাদেশের নাগরিকরা যেন কোনো বাধা বা হুমকি ছাড়াই অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনে ভোট দিতে পারে সেই প্রক্রিয়া তৈরি করার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।

জুলাই গণঅভু্যত্থানের পটভূমি তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত বছর জুলাই মাসে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে বৈষম্য নিরসনের দাবি নিয়ে রাজপথে নেমেছিল।

তিনি বলেন, 'আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীরা ঢাকার দেয়ালগুলোতে গ্রাফিতি এঁকে তাদের আকাঙ্‌ক্ষা ও স্বপ্ন প্রকাশ করেছে।'

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'গত ১৬ বছরে বাংলাদেশে যারা নতুন ভোটার হয়েছেন, তাদের ভোট দেওয়ার সুযোগই হয়নি, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।'

সরকারের সংস্কার এজেন্ডা তুলে ধরে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ৮৪ বছর বয়সী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, দেশের মানুষ কোন ধরনের নির্বাচন চায়, সেটি না জেনে সরকার নির্বাচন আয়োজন করতে

পারবে না।

তিনি বলেন, 'সরকার নির্বাচন আয়োজনের অপেক্ষায় রয়েছে, তবে এখন দেশের জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রক্রিয়াটি কেমন হবে। তারা কি ছোট পরিসরের সংস্কার কর্মসূচিতে যাবে, নাকি দীর্ঘ মেয়াদী সংস্কার চাইবে। যদি মানুষ দ্রম্নত সংস্কার চায়, তাহলে আমরা এ বছরের শেষ নাগাদ নির্বাচন করার লক্ষ্য নিয়েছি। আর যদি বলে, না- আমাদের দীর্ঘ মেয়াদী সংস্কার দরকার, তাহলে আমাদের আরও ছয় মাস সময় লাগবে।'

বর্তমান প্রজন্মকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রজন্ম আখ্যায়িত করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, 'এই প্রজন্মের অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। প্রযুক্তি বর্তমান প্রজন্মকে বদলে দেওয়ার কারণে তারা এখন শুধু বাংলাদেশি আর তরুণ নয় বরং সারা বিশ্বের তরুণ প্রজন্মের অংশ হয়ে গেছে।'

এই প্রজন্ম পুরনো বাংলাদেশে ফিরে যেতে চায় না, তাই একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'তরুণদের কাজের প্রতিটি অংশে ঐকমত্য গড়ে তোলার জন্য একটি ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হচ্ছে। সকল রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজের সংগঠনের ঐকমত্যের ভিত্তিতে 'জুলাই সনদ' প্রস্তুত করা হবে।'

তার সরকার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে তুলে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থায় গতি ফিরে এসেছে। অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে আধা ঘণ্টার আলাপচারিতায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন ক্লাউস শোয়াব।

'হাসিনার আমলে উচ্চ প্রবৃদ্ধির বিষয়টি ভুয়া'

এদিকে, গণ-অভু্যত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারানো শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে দেশে যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছিলেন তা 'ভুয়া' বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একইসঙ্গে হাসিনার 'দুর্নীতি' নিয়ে প্রশ্ন না করায় বিশ্ব সম্প্রদায়কেও দোষারোপ করেছেন তিনি। সুইজারল্যান্ডে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনের ফাঁকে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা।

ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানে ক্ষমতাচু্যত হয়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর গত ৮ আগস্ট নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। তার সরকার প্রথম থেকেই হাসিনার আমলের অনিয়ম-দুর্নীতি ও হত্যা-গুমের সমালোচনা করে আসছে এবং এতে জড়িতদের বিচারের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে।

হাসিনার টানা ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের শাসনকালে প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের নানা গল্প শোনানো হয়। যদিও তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বাকস্বাধীনতা ও বিরোধীমত দমনের অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, হত্যা, গুম, দুর্নীতি এবং অর্থপাচারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং এসবের বিচারের জন্য ঢাকা ভারতের কাছে তাকে প্রত্যর্পণের আবেদন করেছে।

হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ সব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। নয়াদিলিস্নও তাকে প্রত্যর্পণের অনুরোধে এখন পর্যন্ত সাড়া দেয়নি।

ড. ইউনূস বলেন, তিনি (হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে) দাভোসে এসে সবাইকে দেশ চালানোর উপায় শেখাচ্ছিলেন। কেউ তা নিয়ে প্রশ্ন করেনি। এটা একেবারেই ভালো বিশ্বব্যবস্থা নয়।

তিনি আরও বলেন, 'যা ঘটেছে তার জন্য বিশ্বের সবাই দায়ী। গোটা বিশ্বের জন্য এটা একটা শিক্ষা। তিনি (হাসিনা) বলেছিলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধির হার সবার চেয়ে এগিয়ে। এটা ভুয়া প্রবৃদ্ধি, একেবারেই ভুয়া',

শেখ হাসিনার উপস্থাপিত প্রবৃদ্ধির হার কেন ভুয়া তা বিস্তারিত না বললেও ড. ইউনূস সম্প্রসারিত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির গুরুত্ব তুলে ধরেন- যা সম্পদের বৈষম্য কমানোর জন্য জরুরি।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে পড়ে থাকি না। একেবারে নিম্নস্তরের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে আমি মনোযোগী। সেজন্য আমি এমন এক অর্থনীতি গড়ে তোলার পক্ষে- যা সম্পদের কেন্দ্রীকরণের (কতিপয় লোকের হাতে থাকা) ধারণা এড়িয়ে চলে।'

বিতর্কিত ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জিতে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন সরকার গঠন করেন, তখন দেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে তা দেখানো হয় ৮ শতাংশ। যদিও ২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারি ও পরে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এ প্রবৃদ্ধি ধাক্কা খায়।

ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানে গত ৫ আগস্ট হাসিনার সরকারের পতন হয়। আওয়ামী লীগের ওই সরকারকে নয়াদিলিস্নর 'বিশেষ আস্থাভাজন' মনে করা হতো।

ওই সরকারের এমন আকস্মিক বিদায়ের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে নানা ইসু্যতে নয়াদিলিস্নর দূরত্ব তৈরি হয়েছে। হাসিনার স্বৈরশাসনে সমর্থন দিয়ে আসায়, এমনকি জুলাই বিপস্নবের সময়ও তার পক্ষে দাঁড়ানোয় ভারতের সমালোচনা করে আসছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও অভু্যত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা।

প্রধান উপদেষ্টা ভারতে আশ্রিত শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ দাবি করেন, যাতে বিক্ষোভ ও বিরোধীদের দমনে অপরাধের জন্য তাকে বিচারের মুখোমুখি করা যায়।

ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি বন্ধু বলে উলেস্নখ করে ড. ইউনূস বলেন, 'দিলিস্নর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ব্যথিত করেছে।'

প্রায় গোটা বাংলাদেশই ভারতের সীমানাবেষ্টিত জানিয়ে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে অবশ্যই সবচেয়ে শক্তিশালী হতে হবে। আপনি জানেন, বাংলাদেশকে আঁকা ছাড়া ভারতের মানচিত্র আঁকলে সম্পূর্ণ হবে না। '

ইউনূসের 'তিন শূন্য' আন্দোলনের প্রশংসা

এদিকে, কার্বন নিঃসরণ, সম্পদের কেন্দ্রীকরণ ও দারিদ্র্য-বেকারত্ব শূন্যে নামাতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্যোগে চালু হওয়া বিশ্বব্যাপী 'তিন শূন্য' (থ্রি জিরো) আন্দোলনের প্রশংসা করেছেন সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর।

বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ি শহর দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনের ফাঁকে মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন আল গোর। এ সময় তিনি 'থ্রি জিরো' আন্দোলনের প্রশংসা করেন।

বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জলবায়ুকর্মী হিসেবে পরিচিত আল গোর। তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার গৃহীত সংস্কার কর্মসূচিকে সমর্থন করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এসব তথ্য জানান।

সাক্ষাৎকালে উভয় নেতা জুলাই বিপস্নব, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাস, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত সংস্কার কর্মসূচি, নির্বাচন ও ভূ-ূরাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।

সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের সংস্কার কর্মসূচি এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে সমর্থন করার কথা জানান।

জুলাই অভু্যত্থানের সময় আঁকা গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্রের ওপর ভিত্তি করে রচিত শিল্পকর্ম সংকলন 'দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ' বইটি আল গোরকে উপহার দেন মুহাম্মদ ইউনূস।

আল গোর শিল্পকর্ম সংকলনের বই এবং বাংলাদেশের তরুণদের বিপস্নবী চেতনাকে 'অসাধারণ' বলে অভিহিত করেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করল বিশ্বব্যাংক

এদিকে, বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আন্না বিয়ার্দে বাংলাদেশ পুনর্গঠনে অন্তর্র্ব‌তী সরকারের প্রতি বৈশ্বিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটির সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনের ফাঁকে আন্না বিয়ার্দে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এসময় তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে বিশ্বব্যাংকের সমর্থন ব্যক্ত করেন। প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এ তথ্য জানিয়েছেন।

বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আন্না বিয়ার্দে ড. ইউনূসকে উদ্দেশ করে বলেন, আমি আমাদের সমর্থন প্রকাশ করতে চাই। আপনারা যেকোনো সহায়তার জন্য আমাদের ওপর নির্ভর করতে পারেন।

তিনি আরও বলেন, ব্যাংকটি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশের প্রতি তাদের সমর্থন প্রসারিত করতে আগ্রহী।

জুলাই বিপস্নব, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কর্মসূচি এবং দেশের অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও আন্না বিয়ার্দে। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ এবং জেনেভায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি তারেক আরিফুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।##

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে