বুধবার, ০৭ মে ২০২৫, ২৪ বৈশাখ ১৪৩২

অন্তর্বর্তী সরকারকে নিরপেক্ষ থাকতে চাপ বাড়াবে বিএনপি

হাসান মোলস্না
  ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
অন্তর্বর্তী সরকারকে নিরপেক্ষ থাকতে চাপ বাড়াবে বিএনপি
অন্তর্বর্তী সরকারকে নিরপেক্ষ থাকতে চাপ বাড়াবে বিএনপি

দেড় দশকের স্বৈরশাসনের অবসানের পর নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি বাস্তবায়ন সময়ের ব্যাপার মাত্র ভাবা হলেও পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে। নির্বাচন বিলম্ব, সংস্কার ও ক্ষমতাসীনদের একাংশের নেতৃত্বে নতুন দল গঠনের আভাসে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ বাড়ছে। বিশেষ করে বিএনপির দিকে আঙ্গুল তুলে সরকারের এক উপদেষ্টার আক্রমনাত্বক বক্তব্যের কারন খুঁজছে দলটি। সঙ্গত কারনেই অন্তবর্তী সরকারকে নিরপেক্ষ থাকতে চাপ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে বিএনপি।

মঙ্গলবার বিবিসি বাংলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'যদি অন্তর্বর্তী সরকার পূর্ণ নিরপেক্ষতা পালন করে, তাহলেই তারা নির্বাচন কন্ডাক্ট (পরিচালনা) করা পর্যন্ত থাকবে। তা না হলে তো নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে।'

এই বক্তব্যের জবাবে বৃহস্পতিবার বিকেলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে প্রতিক্রিয়া জানান তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, 'বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটি এক-এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে। বিএনপি কয়েক দিন আগে "মাইনাস টুর" আলোচনা করলেও এখন ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করার জন্য নিরপেক্ষ সরকারের নামে আরেকটি এক-এগারো সরকারের প্রস্তাব করছে।

নাহিদ ইসলামের বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গণে উত্তেজনা তৈরি হয়। তার বক্তব্য আক্রমাণাত্মক ছিল বলে মনে করে বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলো। এ বিষয়ে বিএনপির পাশাপাশি তাদের মিত্র দলগুলোর পক্ষ থেকে বক্তব্য আসবে।

রাজনৈতিক বোদ্ধাদের মতে, মূলত সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধীদের দ্বন্দ্ব প্রকট হচ্ছে। বিএনপি দ্রম্নত নির্বাচন দাবি করলেও বৈষম্যবিরোধীরা সময় নিতে চায়। সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে বৈষ্যমীবিরোধীদের দল গঠনের যে অভিযোগ বিএনপি করছে, তাও অমূলক নয়। তাছাড়া রাষ্ট্রপতি অপসারণ, সংবিধান বাতিল ও জুলাই অভু্যত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে তাদের মধ্যে মত বিরোধ আগে থেকেই ছিল। ফলে এক পক্ষ অপর পক্ষের সঙ্গে যে বিরক্তভাব ছিল সেটা প্রকাশ হতে শুরু করেছে।

বিএনপি সূত্রমতে, এতদিন নির্বাচনের দাবিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এলেও কোনো পক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-কোন্দলে জড়াতে চায়নি বিএনপি। কিন্ত সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার পর তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের প্রতিক্রিয়ায় বাধ্য হয়েই বিতর্কে জড়িয়েছে দলটি। যা তাদের প্রত্যাশিত ছিল না। এমন পরিস্থিতিতেও সরকারের নিরপেক্ষতা ও নির্বাচনের কথা বলেই যাবে বিএনপি।

এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কোনো ধরনের 'মাস্টারপস্ন্যান' আছে কিনা-তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এ বিষয়ে শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, 'যখন শুনি আগে সংস্কার পরে নির্বাচন এ যেন শেখ হাসিনার সেই কথারই প্রতিধ্বনি, আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র। এ ধরনের বক্তব্য অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো উপদেষ্টার কাছ থেকে শোভা পায় না।'

সরকারের নিরপেক্ষতার প্রসঙ্গ তুলে রুহুল কবির রিজভী বলেন, 'আমরা তো এ-ও শুনছি, সরকারের ভেতরে থেকে কেউ কেউ রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করছেন। তাহলে তো সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনগণ প্রশ্ন করতেই পারে।'

এই বিএনপি নেতা বলেন, যদি এসব কথা আসে, তাহলে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করা অন্যান্য রাজনৈতিক দল মনে করবে, অন্তর্বর্তী সরকার কোনো ধরনের একটা মাস্টারপস্ন্যানের মধ্যে রয়েছে।

বিএনপি সূত্রমতে, বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা নাহিদ ইসলামের প্রতিক্রিয়ার কারণ খুঁজছেন। কেন তিনি এমন প্রতিক্রিয়া দিলেন, কারো ইন্ধন ছিল কি-না বুঝার চেষ্টা করছে। দলের অনেকের ধারণা, এই বক্তব্য দেওয়ার পেছনে কারো কারো পরামর্শ ছিল, ওই পক্ষটিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে কথা বলেছেন। সেই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া সরকার থেকে আসেনি। নাহিদ ইসলাম সরকারের মুখপাত্রও নয়। তাহলে তিনি কেন-ই বা 'অতিউৎসাহী' হয়ে প্রতিক্রিয়া জানালেন। এ বিষয় তার মধ্যে কেন প্রতিক্রিয়া তৈরি করল?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল হিসেবে যে সরকার গঠন হয়েছে তাকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। বিএনপি মহাসচিব সরকারের সেই নিরপেক্ষার কথাই বলেছেন। কিন্ত এর জবাবে যে বক্তব্য এসেছে তা আক্রমণাত্মক ছিল। তিনি বলেন, সরকারের কেউ দল গঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চাইলে তাকে উৎসাহ দেওয়া হবে। কিন্ত তাকে সরকার থেকে পদত্যাগ করে আসতে হবে।

সুত্রমতে, নাহিদের বক্তব্য নিয়ে বিএনপির কোনো ফোরামে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। তবে নেতাদের আলোচনার মর্ম কথা হল, নাহিদ ইসলামের বক্তব্য সরকারের বক্তব্য নয়। সরকার কোনো প্রতিক্রিয়া দিলে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবে বিএনপি। তাছাড়া 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামেই' সব শিক্ষার্থী নয়। বরং শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি অংশ তারা। তাদের মধ্যেও মতপার্থক্য আছে, যা কয়েকদিন আগে নিজেদের মধ্যে মারামারির ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে।

বিএনপি একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নানা কাজে বিএনপি বিরক্ত থাকলেও তাদের বক্তব্যের কোনো প্রতিক্রিয়া তারা সেভাবে জানায়নি। বরং জুলাই গণভু্যত্থানের ঘোষণাপত্র, রাষ্ট্রপতি অপসারণ ও সংবিধান বাতিলের ইসু্যগুলো বৈষম্যবিরোধী সামনে আনলেও বিএনপি সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের বক্তব্য তুরে ধরেছিল। সামনের সংকটগুলোও সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করতে চায় বিএনপি।

দলের নেতাদের অনেকের ধারণা, একটি রাজনৈতিক দল ছাত্রদের সঙ্গে বিএনপির বিরোধ তৈরি করতে চাইছে। এই বিরোধের ফল তারা ঘরে তুলতে চায়। গত কয়েক মাসের কয়েকটি ঘটনায় তা স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু বিএনপি বিষয়গুলো সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করেছে।

চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হয়ে দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারে না। বললে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা হানী হয়।'

তিনি আরও বলেন, 'অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা নির্দলীয় সরকার মনে করতেই পারি। কিন্ত তাদের কেউ যদি দলীয় লেবাজ ধারণ করে তাহলে সরকার নিরপেক্ষ নয় বলে মনে হবে। রাজনীতি করতে হলে উপদষ্টোদের পদত্যাগ করতে হবে। তারপর অন্যদলের সমালোচনা করতে পারবে। কিন্তু সরকারে থেকে নয়।' ###

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে