রোববার, ১১ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২

উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি

স্বদেশ ডেস্ক
  ২৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি

ভারী বৃষ্টিপাত আর ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নিমজ্জিত দেশের কয়েক জেলা। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন ফেনী, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, হবিগঞ্জ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মৌলভীবাজারের বাসিন্দারা। এসব জেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী কুশিয়ারা, মনু, ধলাই ও জুড়ী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে এসব এলাকায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা।

পানি বাড়তে শুরু করেছে নোয়াখালী অঞ্চলেও। তিন পার্বত্য জেলাসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও দক্ষিণাঞ্চলেও নদ-নদীর পানি বেড়ে তলিয়েছে অনেক নিম্নাঞ্চল। চলমান বন্যায় এখন পর্যন্ত দেশের আট জেলার ২৯ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দুইজনের মৃতু্য হয়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের কারণে হবিগঞ্জ জেলায় বাড়ছে নদ-নদীর পানি। একই সঙ্গে ডুবছে জেলার নিম্নাঞ্চলগুলো। বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত চুনারুঘাট উপজেলায় খোয়াই নদীর বালস্না পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৭৮ সেন্টিমিটার, শায়েস্তাগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৬৭ সেন্টিমিটার, হবিগঞ্জ সদর উপজেলার মাছুলিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল।

এছাড়াও কুশিয়ারা নদীর শেরপুর পয়েন্টে ৮ সেন্টিমিটার, বানিয়াচং মার্কুলি পয়েন্টে ৯ সেন্টিমিটার এবং আজমিরীগঞ্জের কালনী নদীতে ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। জেলায় গত ২৪ ঘণ্টার মোট বৃষ্টিপাত হয়েছে ৫২ মি.মি। বিষয়টি নিশ্চিত করেন হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ।

এদিকে, টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলার অন্তত ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ির সঙ্গে বন্যার পানিতে ভেসে যাচ্ছে রোপা আমনের বীজতলাসহ মাছের ঘের। বন্যা দুর্গতের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম দুর্ভোগ।

নবীগঞ্জ (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ইতিমধ্যে নবীগঞ্জ উপজেলার দীঘলবাক ইউনিয়নের নদীর তীরবর্তী মথুরাপুর, রাধাপুর, দীঘলবাক, গালিবপুর, মাধবপুরসহ বেশ কিছু এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। মাধবপুর স্কুলে বেশ কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছেন ওয়ার্ড মেম্বার আকলু মিয়া।

জানা যায়, বিপুল পরিমাণ বৃষ্টির কারণে ও উজানের ঢলের পানি নেমে আসায় কুশিয়ারা নদীর পানি উপচে উঠছে। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে নদীর পানি। ঝুঁকিতে রয়েছে কুশিয়ারা ডাইক। যে কোনো মুহূর্তে এই ডাইকগুলো ভেঙে পানি প্রবেশ করলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতিসহ নবীগঞ্জবাসী বন্যায় চরম আক্রান্ত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। ইতিমধ্যে অনেক নিচু জায়গায় এবং কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। কেউ কেউ স্থানীয় স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন, আবার কেউ কেউ স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

রামগঞ্জ (লক্ষ্ণীপুর) প্রতিনিধি জানান, লক্ষ্ণীপুরের রামগঞ্জ উপজেলাব্যাপী ১০টি ইউপি ও পৌর শহরে টানা বর্ষণ ও উজানের পানিতে বিভিন্ন সড়কগুলোতে হাঁটু পরিমাণ পানি উঠেছে। এতে পাউবো বাঁধের বাইরে ও ভেতরে ২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি মানুষগুলো উঁচু এলাকা, পাউবো বাঁধের ওপর এবং আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান নিচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো ত্রাণসামগ্রী বিতরণ হয়নি।

বৃহস্পতিবার সরেজমিনে করপাড়া, দরবেশপুর, ভোলাকোট, ভাটরা, নোযাগাও লামচর, চন্ডিপুর ইউপির বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে দেখা যায়, ইউনিয়ন সড়কগুলোতে হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানি ওঠে গেছে। গৃহপালিত পশুগুলোকে সুবিধামতো উঁচু স্থানে কিংবা পাউবো বাঁধের ওপর ঘর তৈরি করে রেখেছে। উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনের সার্বিক নির্দেশনায় কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পানিবন্দি মানুষগুলোকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছে। পদ্মাবাজার সংলগ্ন চনথলা নামক স্থানে সুইসগেট দিয়ে পাউবো বাঁধের ভেতরে স্রোতের বেগে পানি প্রবেশ করছে। ৩-৪ দিন ধরে পানি প্রবেশ করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় গ্রামবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে মাটির বস্তা ফেলে পানি প্রবেশ কিছুটা বন্ধ করেছে। জলাবদ্ধতা বিপৎসীমা অতিক্রম করার কারণে বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য শ্রেণিকক্ষের পাঠদান বন্ধ করেছে।

করপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান জাহিদ মির্জা সাংবাদিকদের জানান, করপাড়া, বদরপুর, গৌরীপুর, ভাটিয়ালপুর, শ্যামপুর গ্রামের সড়কগুলোতে হাঁটু পরিমাণ। কোথাও কোমর পরিমাণ পানি উঠেছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বৃষ্টিতে ভিজে সাধ্যমতো মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি।

লামচর ইউপির সচিব মো. জুলহাস বলেন, সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তালিকা প্রস্তুত করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

তিতাস (কুমিলস্না) প্রতিনিধি জানান, কুমিলস্নার তিতাসে গোমতী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ডুবন্ত বাঁধ ডুবে গেছে। বুধবার গভীর রাত থেকে উপজেলার নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হচ্ছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে গ্রাম থেকে গ্রাম।

সরেজমিনে বৃহস্পতিবার ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার ভিটিকান্দি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঘোষকান্দি থেকে দাসকান্দি বাজার, দাসকান্দি বাজার থেকে হরিপুর ব্রিজ পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধটি বুধবার রাত প্রায় ১টায় ডুবে যায়। বাঁধের ভেতরে থাকা বাড়ি-ঘরসহ বিভিন্ন ফসলি জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। এছাড়াও কলাকান্দি ইউনিয়নের খানেবাড়ি গোবিন্দপুর এলাকায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ একাধিক বসতবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে।

ভিটিকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান বাবুল আহমেদ জানান, ইউনিয়নের দাসকান্দি, ঘোষকান্দি, হরিপুর, রতনপুর, আলীনগর এলাকা উজান থেকে নেমে আসা গোমতীর পানিতে তলিয়ে গেছে। গ্রাম থেকে গ্রাম পর্যন্ত যে সব পাকা ও আধা-পাকা সড়ক রয়েছে সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।

কলাকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান ইব্রাহিম সরকার জানান, কলাকান্দি ইউনিয়নের বেড়ি বাঁধের ভেতরে থাকা দক্ষিণ মানিকনগর, উত্তর মানিকনগর, খানে বাড়ি গোবিন্দপুর ও আফজালকান্দি গ্রাম পানিতে ডুবে গেছে। বন্যাকবলিত মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বলা হচ্ছে।

ইউএনও সুমাইয়া মমিন বলেন, ভিটিকান্দি ও কলাকান্দি ইউনিয়নের বন্যাকবলিত এলাকা আমিসহ সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সকালে পরিদর্শন করেছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যাকবলিত মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাৎক্ষণিক বিতরণের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নতুন করে আরও কিছু এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। ৫টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় ৫ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। হাওড়াবাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। কৃষিজমি ও পুকুর তলিয়ে গেছে। আখাউড়া-আগরতলা সড়কের বিভিন্ন স্থানে পানি উঠছে। স্থলবন্দর এলাকায় পানি উঠায় ইমিগ্রেশন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

এদিকে, বৃহস্পতিবার সকালে বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান। এ সময় দুর্গতদের শুকনো খাবার চিড়া, গুড়, ওরস্যালাইন বিতরণ করা হয়। এ সময় সেনাবাহিনী, পুলিশ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

স্থানীয় ও প্রশাসন সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে বৃষ্টি শুরু হয়ে চলে দিনভর চলে। রাতে কিছু সময় বৃষ্টি বন্ধ থাকে। শেষ রাত থেকে আবারও শুরু হয় বৃষ্টি। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে আসা পাহাড়ি ঢল, বৃষ্টির পানি ও হাওড়াবাঁধ ভেঙে সীমান্তবর্তী উপজেলার দক্ষিণ, মোগড়া ও মনিয়ন্দ ইউনিয়নের বাউতলা, বীরচন্দ্রপুর, কালিকাপুর, বঙ্গেরচর, উমেদপুর, সেনারবাদি, সাহেবনগর, কুসুমবাড়ি, টানোয়াপাড়াসহ অন্তত ৩৫টি গ্রামে কমবেশি পানি ঢুকেছে। গাজীরবাজার এলাকায় অস্থায়ী সেতু ভেঙে স্থলবন্দরগামী সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়েছে।

আখাউড়া উপজেলা কৃষি অফিসার তানিয়া তাবাসসুম বলেন, সাড়ে ১৬শ' হেক্টর কৃষি জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এরমধ্যে রুপা আপন ১৬০০ হেক্টর।

এদিকে, স্কুল মাঠে পানি উঠায় ৭টি প্রাইমারি ও একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ রয়েছে।

ইউএনও গাজালা পারভীন রুহী বলেন, উপজেলার ৩৫টি গ্রামের ৫২০টি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। তাদের আশ্রয়ের জন্য কয়েকটি প্রাইমারি ও হাইস্কুল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সেতু মেরামতের জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগকে খবর দেওয়া হয়েছে।

জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মনজুরুল আলম জানান, হাওড়ানদী ও জাজীরখালসহ বিভিন্ন স্থানে পানি বিপদ সীমার কাছাকাছি রয়েছে। তা অতিক্রম করলে আরও নতুন করে এলাকা পস্নাবিত হতে পারে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা পানির কারণে আখাউড়া উপজেলার ১টি পৌরসভাসহ ৫টি ইউনিয়ন এবং কসবা উপজেলার ১টি ইউনিয়ন বন্যা দেখা দিয়েছে। দুই উপজেলায় প্রায় ১২শ' পরিবার আক্রান্ত হয়েছে। ১৫ মে. টন চাল ও ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছি। ইতোমধ্যে ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় মনু, ফানাই, গোগালীছড়া নদীর একাধিক স্থানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। যার ফলে উপজেলার টিলাগাঁও, জয়চন্ডী, রাউৎগাঁও, সদর ও পৃথিমপাশা ইউনিয়নে বিভিন্ন এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। এসব ইউনিয়নের অর্ধশত গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পাকা, আধপাকা ও কাঁচা সড়ক ভেঙে অনেক এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

জানা যায়, গত তিন দিনের টানা বর্ষণে মনু নদীর অন্তত ৫টি স্থানে, ফানাই নদীর ২টি স্থানে এবং গোগালীছড়া নদীর ১টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তলিয়ে গেছে হাজার একর জমির সাইল-আমনের ক্ষেত। ভেসে গেছে শত শত ফিসারি ও পুকুরের মাছ। প্রতি মুহূর্তে পানির পরিমাণ বাড়ছে। বিগত যে কোনো সময়ের চাইতে এবারের মনু নদীর পানির স্রোত অনেক বেশি। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে কৃষি ও মৎস্য খাতে। রাস্তাঘাটও তলিয়ে গেছে পানিতে। মনু তীরের বাড়িঘরে পানি উঠায় লোকজনরা ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়েছে। গবাদিপশু ও গৃহপালিত পশু নিয়ে রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন লোকজন।

পাউবো জানায়, মনু নদীর রেলওয়ে ব্রিজ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ইউএনও মো. মহিউদ্দিন নদী ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এ সময় ছিলেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শিমুল আলী এবং স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানরা।

ইউএনও মো. মহিউদ্দিন জানান, উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নে পানি প্রবেশ করেছে। এতে বেশ কয়েকটি এলাকায় সহস্রাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। পানিবন্দিদের তাৎক্ষণিক ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

মৌলভীবাজার পাউবো'র নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল জানান, ভারতের ত্রিপুরায় বৃষ্টি হওয়ায় নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃষ্টি কমে গেলে পানি নেমে যাবে। এছাড়া যেসব স্থানে বাঁধ ভেঙেছে সেগুলোতে কাজ চলছে।

নাইক্ষ্যংছড়ি (বান্দরবান) প্রতিনিধি জানান, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নে প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ৮ গ্রামের ৪ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার ভোর রাত থেকে প্রবল বর্ষণ শুরু হলে ইউনিয়নের ৮ গ্রামে পানিবন্দি হয় ৪ শতাধিক পরিবার। ভেসে যায় গরু, ছাগল, হাস মুরগি, নষ্ট হয়ে হয়ে ফসল, বীজতলা। পানিতে ভেসে নিয়ে যায় দক্ষিণ বাইশারী গ্রামের নুরুল আলমের বসতবাড়িসহ কয়েকটি বাড়ি।

দক্ষিণ বাইশারী গ্রামের গ্রামের নুরুল আলম জানান, ভোর রাতের এক ঘণ্টা বৃষ্টিতে পুরো গ্রাম ডুবে যায়। একই গ্রামের বাসিন্দা জুনাইদ জানান তার বসতঘরের ভেতরে প্রচুর পানি। হাঁস-মুরগি পানিতে ভেসে গেছে। একটি গরুও পানিতে ভেসে গিয়ে মারা যায়।

বাইশারী ইউনিয়ন বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী পৃথক দলে পানিবন্দি মানুষের পাশে সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আবদুল করিম বান্টু ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম জানান, বিএনপির পক্ষ থেকে ৩ হাজার মানুষের জন্য দুই বেলা খাবারের ব্যবস্থা করেছেন।

বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর বাইশারী ইউনিয়ন শাখা পানিবন্দি মানুষকে খাবার বিতরণের ব্যবস্থা করেছে বলে জানান জামায়াত নেতা রফিক বশরী।

বাইশারী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মো. আলম জানান, এত পানি আর দেখেননি। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে ইউএনওকে জানিয়েছেন। এছাড়া পানিবন্দি লোকজনের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছেন।

নানিয়ারচর (রাঙামাটি) প্রতিনিধি জানান, ভারী বৃষ্টিপাতে তলিয়ে গেছে রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কের কুতুকছড়ি এলাকার বেইলি ব্রিজসহ কিছু সড়ক। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সড়কের চলাচলের সাধারণ যাত্রী ও এলাকার বাসিন্দারা। হাঁটু সমান পানি হওয়ার ফলে সড়কটি তলিয়ে গেছে। এতে রাঙামাটি-খাগড়াছড়ির সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এছাড়া অতিবৃষ্টিতে নানিয়ারচর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। তবে কোথাও কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

উপজেলায় পাহাড় ধস ও পানির স্রোতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি। ভেঙে গেছে বেশ কয়েকটি মাটির ঘর। বুড়িঘাট ও ঘিলাছড়ি, সাবেক্ষন ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি পাহাড় ধসে রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকতে দেখা গেছে। নানিয়ারচর উপজেলাজুড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে উৎপাদিত ফসলের, বিশেষ করে আনারসের।

এদিকে পাহাড় ধসে যাতে যান চলাচল বিঘ্নিত না হয় সেজন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছেন ইউএনও আমিমুল এহসান খান। পাহাড় ধসে সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় সার্বিক প্রস্তুতি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সংকট মোকাবেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে, একটি রেসকিউ টিম গঠন করা হচ্ছে।

বাজিতপুর (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, নিকলী, কুলিয়ারচরসহ হাওড় অঞ্চলের নদ-নদীতে পানি গত বুধবার থেকে অবিরাম বৃষ্টিতে পানি বেড়েই চলছে। সিলেটের হবিগঞ্জ থেকে পানি আসছে। নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোর হাজার হাজার মানুষ হুমকিতে বসবাস করছে। যে কোনো মুহূর্তে এসব অঞ্চল ডুবে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। তবে গত ১ মাস আগে ঘোড়াউত্রা নদীর পানিতে বাজিতপুরের দিঘীরপাড় ইউনিয়নের আছানপুর, কচুয়াখলা, মাইজচর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম হুমকির মুখে ছিল। এছাড়া নিকলী উপজেলার ছাতিরচর ইউনিয়ন, সিংপুুর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম নিচু জায়গাগুলো পানিতে নিমজ্জিত ছিল। বর্তমানে যেভাবে এসব নদীগুলো দিয়ে পানি বাড়ছে আগে থেকেই এসব বানভাসি মানুষের জন্য সরকারিভাবে পদক্ষেপ না নিলে এসব অঞ্চল বন্যার কবলে পড়বে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে