ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের প্রসার ঘটাতে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড পাবনার ঈশ্বরদীতে গড়ে তোলে 'বেনারসি পলস্নী'। কিন্তু ২০ বছরেও পূর্ণতা পায়নি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঈশ্বরদী বেনারসি পলস্নী প্রকল্প। তাঁত কারখানা গড়ে ওঠার পরিবর্তে বর্তমানে পলস্নীর অভ্যন্তরে চলছে সবজির চাষ। প্রকল্প এলাকা ভরে গেছে জঙ্গল ও আগাছায়। এ অবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়েছে পুরোপ্রকল্প ব্যবস্থা।
বেনারসি পলস্নী কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের উত্তরাঞ্চলে কর্মরত কয়েক হাজার তাঁতির অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা, বেনারসি শিল্পকে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা প্রদান ও শিল্পের প্রসার ঘটাতে তাঁত বোর্ড ঈশ্বরদীতে বেনারসি পলস্নী স্থাপনের জন্য ৯০ দশকে পরিকল্পনা হাতে নেয়। ২০০০ সালে প্রকল্পের অধীনে 'ঈশ্বরদী বেনারসি পলস্নী' নামকরণে শুরু হয় এর নির্মাণ কাজ। সে সময় ২ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে শহরের ফতে মোহাম্মদপুর এলাকায় ৫ দশমিক ০৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। এরপর আরও কিছু অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে পলস্নীর ভেতরে বিদু্যৎ, পানি, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, সীমানা ও নিরাপত্তা প্রাচীর, অফিস এবং মসজিদ নির্মাণসহ তাঁতিদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়। ২০০৪ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তৎকালীন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী শাজাহান সিরাজ এমপি। কিন্তু এরপর প্রকল্পটির দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঈশ্বরদী বেনারসি পলস্নীতে মোট ৯০টি পস্নট রয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে চললেও এখনো পূর্ণাঙ্গ পস্নট বা কারখানা গড়ে উঠেনি। সর্বশেষ মাত্র পাঁচটি বেনারসি কারখানা চালু হলেও ইতোমধ্যে একটি বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি ৪টি চালু থাকলেও নানা কারণে তাঁতের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এ ছাড়াও ঋণের বিপরীতে কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় ১৪টি পস্নট বাতিল হয়েছে। আরও ২২টি পস্নট বাতিলের পথে বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
স্থানীয় তাঁতিদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে সঠিক পরিকল্পনা, উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষক ও সুষ্ঠু তদারকির অভাবে দুই দশকের এ প্রকল্পটি মুখথুবড়ে পড়ে আছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এখান থেকে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও তাঁতশিল্পে তেমন বিকাশ ঘটেনি।
কয়েকজন তাঁতি জানান, 'পলস্নী উদ্বোধনের পর আমাদের কয়েকটি দাবি বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের কাছে তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো ছিল- ২০ বছর মেয়াদে ২৪০ কিস্তিতে সুদমুক্ত ঋণ বিতরণ, সরকারি অর্থায়নে বেনারসি পলস্নীর পস্নটে কারখানা ও আবাসন নির্মাণ, সাঁথিয়ার পরিবর্তে ঈশ্বরদীর তাঁতিদের জন্য একটি বেসিক সেন্টার ও ক্যালেন্ডার মেশিন স্থাপন করা। কিন্তু দীর্ঘ সময় পার হলেও তাঁত বোর্ড সেই দাবি মানেনি।'
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পলস্নীর অভ্যন্তরে বিশাল জায়গা জুড়ে ঢেঁড়স, বেগুন, শিম, করলাসহ সবজির বাগান করা হয়েছে। অফিসের আশপাশে ৭-৮টি সবজির খেত দেখা যায়। কেউ কেউ সেখানে বাঁশের 'বাতা' ও খুঁটি গেড়ে মাঁচা তৈরি করেছে। দোতলার ভবনটি জরাজীর্ণ। অফিসের জানালা-দরজার কাচ ভাঙা, দেওয়ালে রঙ ও পলেস্তারা চটে শ্যাওলা জমে আছে। চেয়ার টেবিল নষ্টের উপক্রম। ময়লা ও পুরানো আসবাবপত্র পড়ে আছে বারান্দায়। অফিসের চারিদিকে জঙ্গল। দূর থেকে ২-৩টি কারখানা দেখতে পাওয়া যায়।
পলস্নীর অভ্যন্তরের সবজি ক্ষেত থেকে সবজি সংগ্রহকারী দুইজন নারীর কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, এলাকার মানুষ হিসেবে তারা পলস্নীর জায়গায় সবজি চাষ করেছেন। এজন্য বছরে কিছু টাকা মসজিদের উন্নয়নে দিয়ে থাকেন।
এখানকার একটি কারখানা তাঁতি শরিফুল ইসলাম জানান, এখনও স্থায়ী কারখানা গড়ে ওঠেনি। যে কয়েকটি কারখানা আছে সেগুলো তারা নিজ অর্থায়নে তৈরি করেছেন। তবে আর্থিক সংকটের কারণে এগুলো প্রায় বন্ধ থাকে।
ঈশ্বরদী বেনারসি পলস্নীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহ জামাল বলেন, পলস্নীর প্রায় সবগুলো পস্নট পর্যায়ক্রমে তাঁতিদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পলস্নীর পস্নট গ্রহীতা কিস্তির টাকা পরিশোধ করেনি। এছাড়া পূর্ণাঙ্গ কারখানাও গড়ে ওঠেনি। বরাদ্দ পাওয়া তাঁতিরা পস্নটে কারখানা করবেন এমন লক্ষণ দেখা যায় না। পুঁজির অভাবও রয়েছে তাদের। তারা সরকারের ঋণের অপেক্ষায় আছেন। চলতি বছরের ডিসেম্বরেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে।