১২ ডিসেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুর মুক্ত দিবস। ধর্ষণ, গণহত্যা, বসতভিটায় অগ্নিসংযোগ, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের হত্যার পরে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে চলে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধ। শ্রীপুর থেকে পাকিস্তানি সেনাদের যোগাযোগের জন্য রেলপথ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। চারদিক থেকে প্রচন্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে লেজ গুটিয়ে ১১ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে শ্রীপুর ছাড়ে হানাদার বাহিনী আর আত্মগোপনে চলে যেতে থাকে রাজাকার ও তাদের দোসররা। ১৯৭১ সালের এই দিনে শ্রীপুর উপজেলা শত্রম্নমুক্ত হয়ে ওড়ে লাল-সবুজের পতাকা।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, শ্রীপুরের ইতিহাস ও কৃষ্টি বই সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল হানাদার বাহিনী শ্রীপুরে অবস্থান নেয়। শ্রীপুর থানা চত্বর, গোসিংগার কাচারী বাড়ি, কাওরাইদ রেলস্টেশন, সাতখামাইর স্টেশন, গোলাঘাট ব্রিজ, ইজ্জতপুর ব্রিজ, বলদিঘাট হাইস্কুল ও গাজীপুরে গড়ে তোলা হয় আটটি পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্প। রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাস থেকে ট্রেনযোগে শ্রীপুরে ছিল হানাদারদের সহজ যোগাযোগ। শ্রীপুর থানায় ছিল হানাদারদের প্রধান ঘাঁটি। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় হানাদার বাহিনী নিরীহ নারী-পুরুষ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের ধরে এনে এসব ক্যাম্পে বর্বর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করত। শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ সংলগ্ন বধ্যভূমি ও সাত খামাইরের গণকবর আজ ও হানাদার বাহিনীর বর্বরতার সাক্ষ্য বহন করে।
যুদ্ধকালীন সময়ের গ্রম্নপ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ কাদির বলেন, ৭ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে সর্ব প্রথম বরমী ইউনিয়নের গোলাঘাট ব্রিজ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখী যুদ্ধে অংশ নেয় মুক্তি বাহিনী। হানাদার বাহিনীর ওপর প্রতিশোধ নিতে মুক্তিযোদ্ধরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে আক্রমণের ছক তৈরি করেন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সেকশন কমান্ডার মিয়ার উদ্দিন ও নূরু মন্ডলের নেতৃত্বে উড়িয়ে দেওয়া হয় রাজাবাড়ির পারুলী নদীর ব্রিজ। একইসঙ্গে গোসিংগা, কাওরাইদ, ইজ্জতপুর, গোলাঘাট ও সাতখামাইরে দুইটিসহ ছয়টি সম্মুখযুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের একের পর এক গেড়িলা হামলা ও প্রচন্ড আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙে একপর্যায়ে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে পিছু হটতে শুরু করে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে থানা ক্যাম্প ঘিরে ফেলে। শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণ। বন্ধ করে দেওয়া হয় হানাদারদের রশদ, খাদ্য সরবরাহ। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যোগাযোগ। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণে হানাদার বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কিশোর সাহাব উদ্দিন শহীদ হওয়ার চার দিন পর ১১ ডিসেম্বর বিকাল পৌনে পাঁচটার দিকে মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক নূর মোহাম্মদ ফকিরের নেতৃত্বে এক দল মুক্তিযোদ্ধা ইজ্জতপুর থেকে শহীদ সাহাব উদ্দিনের মরদেহ উদ্ধারের অভিযান চালায়। এ সময় হানাদার বাহিনীর টহল ট্রেন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি গুলি চলে। চারদিক থেকে আক্রমণে টিকতে না পেরে ১১ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে হানাদার বাহিনী শ্রীপুর ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১২ ডিসেম্বর ভোরে শ্রীপুর সম্পূর্ণরূপে হানাদার মুক্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পরে। উলস্নাসিত জনতার পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে চারদিক। শ্রীপুরের মাটিতে উড়ে স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজের পতাকা।
ডোমার (নীলফামারী) প্রতিনিধি জানান, আজ ডোমার হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে ১২ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর হাত থেকে ডোমার উপজেলাকে মুক্ত করে বীর মুক্তিকামী সেনারা। ডোমার থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় হানাদার বাহিনী শহরে ব্যাপক ধংসযজ্ঞ চালায়। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তাদের দোসররা শহরের দোকানপাটে লুটপাট চালায়। পাশাপাশি ডোমার উপজেলার সঙ্গে ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম বোড়াগাড়ী ব্রিজটি আর্টিলারি সেল নিক্ষেপ করে ভেঙে দেওয়া হয়। ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বোড়াগাড়ী ভাটিয়াপাড়া এলাকায় মসজিদে আজান দেওয়ার সময় হানাদার বাহিনীর গুলিতে নিহত হন এক ব্যক্তি। ওই রাতে ডোমার থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন ঘুমিয়ে থাকা পাকিস্তানি সেনা দল থেকে ছাড়া পড়েন। পরদিন এলাকার লোকজন তাদের ধরে গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সোনারায় এবং ডোমারের বিভিন্ন এলাকা ঘুড়িয়ে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে সোপর্দ করেন। ১২ ডিসেম্বর ডোমার হানাদার মুক্ত হলে উলস্নাসে আত্মহারা হয়ে পড়ে সবাই। স্থানীয় ডাক বাংলো মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ক্যাপ্টেন ইকবালের নেতৃত্বে একটি আনন্দ বিজয় মিছিল শহরে প্রবেশ করে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ ববিন জানান, 'আমাকে ভারতের কোটগজ থেকে লালমনিরহাটের বুড়িমারী পাটগ্রাম ফকিরপাড়ায় ভারতীয় আর্মিদের কোম্পানির সঙ্গে বদলি করা হয়। সেখানে যুদ্ধকালীন অবস্থান করা সময়ে ভারতের সেখানকার ওয়ার্লেস অপারেটরের কাছে জানতে পারি ১১ ডিসেম্বর ডোমার হানাদার মুক্ত হয়। ডোমারে এসে জানতে পারি ১২ ডিসেম্বর পতাকা উত্তোলন ও বিজয় মিছিল হয়। ১৩ ডিসেম্বর নীলফামারী হানাদার মুক্ত হয়।'
ডোমার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার আব্দুল জব্বার জানান, 'আমি তখন দিনাজপুর চালহাটি ক্যাম্পে ছিলাম। দেশ স্বাধীনের পর ডোমারে আসি। এসে আমার অনেক মুক্তিযোদ্ধা এবং এলাকার লোকজনদের কাছে জানতে পারি ১২ ডিসেম্বর ডোমার হানাদার মুক্ত হয় এবং সেদিন ক্যাপ্টেন ইকবালের নেতৃত্বে স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলন ও একটি বিজয় মিছিল করে। আগামী প্রজন্ম যাতে সঠিক ইতিহাস জানতে পারে সে বিষয়ে সবার সহযোগিতা দরকার।