যশোর শহরের ভৈরব পাড়ের দুই কিলোমিটারের মধ্যে ভয়াবহ নদী ধসে অন্তত ৮০ পরিবারের বাড়িঘর ভেঙে গেছে। নদ থেকে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডে অপরিণামদর্শী কর্মকান্ডের ফলে এ ঘটনা ঘটেছে বলে ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ। জমি-বাড়ি ধসে এই পরিবারগুলোর অন্তত আট কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, ভৈরব খননের প্রকল্প চলাকালে প্রভাবশালী একটি মহল একাধিক ড্রেজিং মেশিন দিয়ে কয়েক বছর ধরে বালু উত্তোলন করে তাদের এমন বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, বালু উত্তোলনের কারণে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে কিনা তাদের জানা নেই। নদী গর্ভে 'গর্ত' হওয়ার কারণে মাটি সরে যাওয়ায় এ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২০ সালের একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান শহরের কাজীপাড়া আব্দুল আজিজ সড়কের তেঁতুলতলা কালভার্টের কাছে ভৈরব নদে ড্রেজিং মেশিন স্থাপন করে বালু উত্তোলন শুরু করে। দীর্ঘ পাইপলাইন স্থাপন করে এক কিলোমিটারেরও বেশি দূরে শহরের পুলিশলাইনের মধ্যবর্তী সরকারি পুকুর ভরাট শুরু করে। তখন থেকেই জনউদ্যোগ নামে একটি পরিবেশবাদী সংগঠন এই বালু উত্তোলনের প্রতিবাদে প্রেসমিট করে এবং প্রশাসনকে স্মারকলিপি দেয়। প্রশাসন কথাও দেয় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের। কিন্তু বালু উত্তোলন বন্ধের পরিবর্তে আরও বেশিমাত্রায় তোলা শুরু হয়। এমনকি পুলিশলাইনের কাজটি সম্পন্নের পর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে বালুখেকোদের। স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধির নেতৃত্বে ব্যাপকমাত্রায় বালু উত্তোলন শুরু হলে ভৈরবের বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে ওঠে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের পুরাতন কসবা ঘোষপাড়া, রায়পাড়া ও বাবলাতলা এলাকার ভৈরবপাড় জুড়ে ভূমিধস ও ভাঙন দেখা দিয়েছে। স্রোতবিহীন নদের দুই পাশে ছোট-বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে; দেবে যাচ্ছে নদের পাড়। ভৈরব পাড়ের এই দুই কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ৮০টি পরিবার ভাঙনের শিকার হয়েছে। তাদের অন্তত ৮ কোটি টাকার জমি-বাড়িঘর গাছপালা নদীর গ্রাসে চলে গেছে।
ভৈরব নদের বাবলাতলা ব্রিজের পাশে ধার-দেনা করে ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে বাড়ি করেছিলেন প্রাইভেটকার চালক কেরামত আলী। গত অক্টোবর মাসে তার বাড়িটি ধসে পড়েছে। সোয়া ৮ শতক জমির সিংহভাগই নদীর পেটে চলে গেছে। শ্রমজীবী কেরামত আলী জানান, বাড়ি নির্মাণের সব লোন বাকি, এখনো শোধ হয়নি। ইটভাটায় বাকি, রড-সিমেন্টের দোকানে বাকি আর এনজিও'র লোন মিলে ৫ লাখ টাকা এখনো দেনা। এর মধ্যে বাড়ি ভেঙে নদীতে চলে গেছে; যেটুকু টিকে আছে তার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন।
ভৈরব পাড়ের বাবলাতলা এলাকার বাসিন্দা চাকরিজীবী শরিফুল ইসলাম বলেন, নদী খননের সময় ঠিকাদারের মাটি কাটার কথা। কিন্তু তারা মেশিন লাগিয়ে বছরের পর বছর বালু তুলেছে। এ বালু তোলায় গত বর্ষার পর থেকে নদীর পাড় ধসে পড়ছে। এর সঙ্গে ঘরবাড়িতে ফাটল দেখা দিচ্ছে; ধসে পড়ছে। প্রায় দশ লাখ টাকা খরচ করে সাত মাস আগে তিনি বাড়ি করেছিলেন। সেই বাড়ি ভেঙে গেছে। পুরাতন কসবা রায়পাড়া এলাকার গৃহবধূ বেবী খাতুন জানান, তাদের বাড়ির দেওয়ালে হাল্কা ফাটল দেখা দিয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনটি বেডরুম, ডাইনিং, ড্রইং ও বাথরুম পুরোটাই ধসে ভেঙে পড়ে। এছাড়া পুরাতন বাসার সঙ্গেই নতুন ঘর তুলছিলেন, সেগুলোও ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে।
প্রিয়াংকা অধিকারী বলেন, বৃষ্টিতে একটু একটু করে ফাটল ধরে। তারপর হঠাৎই ঘর মাটিতে দেবে যায়। দুই বছর ধরে নদী থেকে বালু তোলার কারণে এটা হয়েছে। সবাই জানলেও কেউই প্রকাশ্যে বালুখেকো জনপ্রতিনিধির নাম নিতে সাহস পাননি।
উপশহরের ভৈরব পাড়ের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আসাদুল ইসলাম বলেন, বাড়িঘর ধসে যাওয়ায় তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে নদের তীর রক্ষা ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানান। তারা পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দিলেও তার কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।
ভৈরবের বালু উত্তোলনের প্রতিবাদে সোচ্চার থাকা সংগঠন 'জনউদ্যোগ, যশোর'র আহ্বায়ক প্রকৌশলী নাজির আহমেদ বলেন, নদী খাত থেকে বালু উত্তোলন গভীর, সুগভীর নাকি উপরিতল থেকে হবে, তার ভিত্তিতে বিপর্যয়ের মাত্রা ও স্থায়িত্ব নির্ভর করে। হঠাৎ করে কোনো স্থান পাশের স্থানের চেয়ে গভীর করে খনন করে বালু উত্তোলন করা হলে পার্শ্ববর্তী চতুর্দিকের মাটি বা ভূমি বছরের পর বছর ধরে ধসে যেতে থাকবে এবং এর প্রভাবে আশপাশের স্থাপনা ও বসতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গভীরতা যত বেশি হবে, ধসের এলাকাও তত বেশিদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। তিনি উলেস্নখ করেন, এ অঞ্চলের অন্তত ৮০ পরিবার ঠিকাদার ও বালুখেকোদের অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডে অপরিণামদর্শী কর্মকান্ডের শিকার হয়েছেন। ৪ বছর আগে আমাদের সতর্কবাণীকে আমলে নেওয়া হয়নি বলেই আজকের এ বিপর্যয়। এতে তাদের অন্তত ৮ কোটি টাকার জমি, বাড়িঘরসহ সহায় সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী জিএম রাইসুল ইসলাম জানান, ভৈরবপাড়ের ধসেপড়া এলাকায় বাঁশের খুঁটি পুঁতে জিও ব্যাগ দিয়ে পাড় রক্ষার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পাড় রক্ষা ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী বলেন, 'স্থানীয়রা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভৈরব থেকে বালু উত্তোলনের কারণে এটা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে। বালু উত্তোলন হয়েছে কিনা, আমার জানা নেই। তবে গর্ত সৃষ্টি হয়ে নদের পাড়ের এলাকা দেবে গেছে। আমরা বাঁধ দেওয়ার কাজ শুরু করেছি। ধারাবাহিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পুরো এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করা হবে।'