দেশের বিভিন্ন স্থানে গত কয়েকদিন ধরে শুরু হয়েছে হাড়কাঁপানো শীত। তবে বুধবার মধ্যরাত থেকে হাড়কাঁপানো শীতের সঙ্গে দেখা দিয়েছে শৈত্যপ্রবাহ। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে অনেক এলাকা। কনকনে ঠান্ডায় বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। এদিকে, গত বুধবার ঘন কুয়াশায় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ৭ ঘণ্টা পর ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-
গাংনী (মেহেরপুর) প্রতিনিধি জানান, মেহেরপুরের গাংনীতে কয়েকদিন ধরে হাড়কাঁপানো শীতের সঙ্গে চলছে শৈত্যপ্রবাহ। হাড়কাঁপানো শীতে শুধু জনজীবন নয়, জবুথবু হয়ে পড়েছে প্রাণীকুলও। কনকনে ঠান্ডায় বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। হিমেল হাওয়া আর হাড়কাঁপানো শীতে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না।
ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে নেমে এসেছে হাহাকার। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করছেন তারা। এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়নি। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০.২ ডিগ্রি। গত বুধবার সকাল ৯টায় ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াজ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। গত সোম ও মঙ্গলবার তাপমাত্রা ছিল ১২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শৈত্যপ্রবাহ আরও কয়েক দিন অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস দিয়েছে চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিস।
গাংনী উপজেলায় জেঁকে বসা শীতের পাশাপাশি কুয়াশার কারণে সূর্যের দেখা মেলেনি গত তিন দিন। ঘন কুয়াশার কারণে ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল। দূরপালস্নার বাস-ট্রাকসহ ছোট ছোট যানবাহনগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে চলতে দেখা যাচ্ছে। দিনের তাপমাত্রা কিছুটা সহনীয় হলেও রাতে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। হাড়কাঁপানো শীতে বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন শ্রেণির খেটে খাওয়া মানুষ। কনকনে শীতের কারণে কাজে যেতে পারছেন না অনেকেই। তবুও পেটের তাগিদে কাউকে রিকশা, ভ্যান বা ক্ষেত খামারে দিনমজুরের কাজ করতে যেতে দেখা গেছে।
শহরের অটোচালক মাসুদ আলী জানান, প্রচন্ড শীতে লোকজন বাইরে বের হচ্ছেন না। যে কারণে ভাড়াও হচ্ছে না। সারাদিন গাড়ি চালিয়ে ২-৩শ' টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। এদিকে অটো চালাতে গিয়ে হাত-পা ঠান্ডায় শক্ত হয়ে যাচ্ছে। একই কথা জানালেন বামন্দী বাজারের রিকশা চালক তমেজ ও বাবুল আকতার। ভাড়া না পেয়ে তাদের প্রতিদিনের রিকশা বাবদ গ্যারেজে জমা (টাকা) দিতে পারছেন না। ফলে পরিবার নিয়ে সংকটে রয়েছেন। কালিগাংনী গ্রামের দিন মজুর নাজিরা খাতুন জানান, তারা রাস্তার মাটি কাটার কাজ করেন। তাদের দলে ১৫ জন নারী শ্রমিক আছেন। কাক ডাকা ভোরে কাজের সন্ধানে বাড়ি থেকে বের হয়ে শহরে আসেন তারা। বিভিন্ন এলাকার গেরস্থরা গাংনী উপজেলা শহর থেকে দৈনিক চুক্তিতে নিয়ে যান। প্রচন্ড শীতের কারণে গেরস্থরা আসছেন না। ফলে মাঝে মধ্যে কাজ না পেয়ে শূন্য হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে। কাপড়ের দোকানি রবিউল ইসলাম ও আয়ূব আলী জানান, শীতের কারণে সকালে দোকান খোলা সম্ভব হচ্ছে না। আবার দুপুর পর্যন্ত কোনো ক্রেতার দেখা মিলছে না। তাই বেচাকেনাও ভালো হচ্ছে না।
এদিকে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে রোগীদের ভিড় লক্ষণীয়। ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে গত তিন দিনে ৬৯ জন রোগী গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে ভর্তি হয়েছেন। এদের সিংহভাগই বৃদ্ধ ও শিশু। ক্রমশ রোগীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঠান্ডা ও বাসি খাবার পরিহার ও গরম কাপড় ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সুপ্রভা রাণী।
এখনো সরকারিভাবে কোনো শীতবস্ত্র পাওয়া যায়নি এবং পাওয়া গেলেই তা বিতরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন গাংনী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রীতম সাহা।
গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) প্রতিনিধি জানান, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে দীর্ঘ সোয়া ৭ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর ফেরি চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। বুধবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে কুয়াশার ঘনত্ব কমে আসলে ফেরি চলাচল পুনরায় শুরু করে বিআইডবিস্নউটিসি।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে ঘন কুয়াশার কারণে ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। চ্যানেলের বিকন বাতি ও মার্কিং পয়েন্টগুলো অস্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনা এড়াতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিআইডবিস্নউটিসি'র দৌলতদিয়া ঘাট শাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, কুয়াশা কেটে যাওয়ার পর ফেরি চলাচল শুরু হয়েছে। বর্তমানে যাত্রী ও যানবাহন নির্বিঘ্নে পারাপার করছে।
এদিকে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় মাঝ নদীতে দুটি ফেরি আটকা পড়ে। এতে যাত্রী, চালক ও ব্যবসায়ীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বিশেষ করে জরুরি পণ্যবাহী ট্রাক ও যাত্রীরা এ পরিস্থিতিতে ভোগান্তির শিকার হন। তবে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক হওয়ায় যাত্রীরা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। বর্তমানে এ নৌরুটে ছোট বড় ১৭টি ফেরি দিয়ে যানবাহন ও যাত্রী পরিবহণ কার্যক্রম আগের মতো চলমান রয়েছে।
আড়াইহাজার (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, গত এক সপ্তাহ ধরেই শীত পড়েছে প্রচুর। শীতে অনেকটাই যার জবুথবু নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের জনজীবন। ভোর বেলায় ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে পুরো এলাকা। ঘন কুয়াশার কারণে দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। পোলট্রি খামারগুলোতে মুরগি অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
শীতের আমেজ পুরোপুরিভাবে যদিও পড়েনি, তবুও শীতের আগমনী বার্তা জানান দিয়েছে অনেক আগেই। যদিও আড়াইহাজার উপজেলার অনেক এলাকাতেই এখন আর শীতকালে সাঁঝের বেলায় খেজুর গাছ অথবা তাল গাছে রস নামানোর জন্য গাছিদের গাছ কাটতে দেখা যায় না। কারণ কালের বিবর্তনে আড়াইহাজারের অনেক এলাকা থেকে খেজুর ও তালগাছ কমে গেছে। ইরি বোরো ধানের চাষাবাদের ফলে এ এলাকা থেকে আমন ধানের চাষাবাদও অনেকটা উঠে গেছে। ফলে শীতের সকালে পিঠাপুলিও বানাতে তেমন একটা দেখা যায় না। আড়াইহাজারে শীত এখন শুধু অনুভব করা যায়।
সালথা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি জানান, হঠাৎ সকাল থেকে কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে ফরিদপুরের সালথা। বৃহস্পতিবার সূর্যের দেখা মেলেনি এ অঞ্চলে, কুয়াশায় ঢেকে থাকে সারাদিন। ঘন কুয়াশার কারণে কয়েক হাত দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছে না। উপজেলার সব জায়গায় এমন চিত্রই চোখে পড়ে।
সরেজমিন দেখা যায়, ভোরের পর থেকে কুয়াশার চাদরে আড়াল হতে থাকে প্রকৃতি। বাংলা পৌষ মাসের শুরুতে ঠান্ডা প্রকৃতি আর এমন কুয়াশা এসব এলাকার জনজীবনে কর্মের ব্যাঘাত ঘটে। তবে থেমে নেই কর্মজীবী মানুষের চলাচল। কুয়াশার সকালে কৃষকরা নেমে পড়ছেন মাঠে। সড়কগুলোতে ছিল না কোনো যানবাহন। বেলা বাড়লেও কুয়াশার আধিক্য থাকায় সালথায় সূর্যের দেখা মেলেনি কোথাও। এ অবস্থায় শীতে ও কুয়াশায় অসুবিধায় পড়ার কথা জানালেন কৃষকরা। কৃষকরা জানান, শীতের দিন মাঠে কাজ করতে ও দোকান চালানো খুব কষ্ট হয়ে যায়। নাক, মুখ দিয়ে ঠান্ডা কুয়াশা ঢুকে পড়ে। কুয়াশার কারণে শীতের দিনে গাড়ি চলাচল ব্যাহত হওয়ায় সকালে গন্তব্যে পৌঁছাতেও অনেক দেরি হয়ে যায় বলে জানান ভ্যান চালকরা। তারা জানান, শীতের দিনে অনেক সতর্কতার সঙ্গে ভ্যানগাড়ি চালাতে হয়। বেশি জোরে গাড়ি চালানো যায় না। এবার অন্য বছরের তুলনায় শীতের প্রভাব বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ফরিদপুর আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, সারাদেশে শেষ রাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঘন কুয়াশা ও মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে। শেষ রাত থেকে সকাল পর্যন্ত নদী অববাহিকায় মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা এবং দেশের অন্যত্র হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে।