সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

পূর্বধলার আতঙ্ক সাবেক এমপি বেলাল এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে

পূর্বধলা (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি
  ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
পূর্বধলার আতঙ্ক সাবেক এমপি বেলাল এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে

দেড় দশক ধরে তিনি ছিলেন উপজেলাবাসীর জন্য এক মুর্তিমান আতঙ্ক। যার নাম শুনে বাঘে মহিষে এক ঘাটে জল খেত। তার দাপটে উপজেলাবাসী সব সময় থাকত তটস্থ। তাকে কেউ স্যার সম্বোধন ছাড়া কথা বলতেই সাহস পায়নি। তিনি ছিলেন এলাকার স্বঘোষিত সম্রাট।

বলা হচ্ছে ১৬১, নেত্রকোনা-৫ পূর্বধলা আসনের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক টানা তিনবারের সংসদ সদস্য, পূর্বধলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীরপ্রতীকের কথা। ২০০৮ থেকে ২০২৩ এ দেড় দশক পূর্বধলা উপজেলার সব কিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে অপ্রতিরোধ্যভাবে পূর্বধলার জনগণকে শাসন এবং শোষণ করেছেন। বিএনপি-জামাত-শিবিরের নেতা কর্মীদের উপর নানা অজুহাতে প্রায় অর্ধ শতাধিক মিথ্যা, সাজানো মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন বছরের পর বছর। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগেই তিনি কৌশলে নিজেকে আড়াল করে নিয়েছেন। ইতিমধ্যে তার নানাবিদ অপকর্মের বিচারের দাবী উঠছে বিভিন্ন মহলে। একটি হত্যা মামলায় প্রধান আসামী করে পূর্বধলা থানায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হলেও তিনি এখনো রয়েছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

জাসদের রাজনীতি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের মাধ্যমে নব্বই দশকে পূর্বধলায় রাজনীতিতে আসেন ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারে মত এ আসন থেকে নৌকার টিকিট নিয়ে নির্বাচন করে আলোচনায় আসেন তিনি। তখন নির্বাচনে পরাজিত হয়েও নিজের অবস্থান ধরে রাখতে ২০০৩ সালে বাগিয়ে নেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদটি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত নানা কৌশলে কোন সম্মেলন ছাড়াই তিনি পদটি ধওে রেখেছেন। ২০০১ এর নির্বাচনে দলীয় টিকেট না পেলেও ২০০৮সালে তিনি প্রথমবারে মত এ আসনে এমপি নির্বাচিত হন। সেই থেকে শুরু হয়ে তার ক্ষমতার দাপট। পরবর্তীতে ২০১৪ এর নির্বাচনে বিনা ভোটে এবং ২০১৮ এর নির্বাচনে রাতের ভোটে বিনা খরচে তিনি এমপি নির্বাচিত হন।

এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনী প্রচারানয় 'মুদ্রার এপিটও দেখেছি, ওপিটও দেখেছি। টাকার প্রতি আমার কোনো লোভ নেই। সবকিছু মানুষের সেবায় বিলিয়ে দিতে চাই।' নিজেকে শিল্পপতি পরিচয় দিয়ে নির্বাচনী প্রচারনায় এমন চটকধারী কথা বলে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। এমপি হয়েই নানা দুর্নীতির মাধ্যমে কামিয়েছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। দেড় দশকে তিনি নানা দুর্নীতি, অপকর্ম, চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, কমিশন বাণিজ্য, নারী কেলেংকারীর মাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন। তার চাঁদাবাজি থেকে অটোরিকশা, সিএনজিসহ কোন পরিবহনই বাদ যায়নি।

এ সব কাজে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের জন্য ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান পদেও তার পছন্দসই প্রার্থীদের তিনি নানা কারিশমায় বিজয়ী করেছেন।

উন্নয়নের নামে ভুঁয়া প্রকল্প দেখিয়ে সমুদয় টাকা আত্মসাৎ করতেন। এমপি বেলাল তার আমলে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে বেসরকারী স্কুল, কলেজ, মাদরাসা থেকে শত শত কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে একজন পিয়ন নিয়োগ হলেও ৮ থেকে ১০লাখ টাকা দিতে হত তাকে। এছাড়া সরকারী প্রাইমারী স্কুলের নৈশ্যপ্রহরী নিয়োগ দিয়েও জনপ্রতি ৮থেকে ১০লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন। পলস্নী বিদু্যতের লাইন নির্মাণের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে তার লোকজনদের মাধ্যমে তুলে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। তার এ সকল অপকর্মের যারা সহযোগী ছিলেন তারা এখন গা ঢাকা দিয়েছেন।

এমপি বেলাল পুরো উপজেলায় প্রতিহিংসার রাজনীতি কায়েম করেছিলেন। তার প্রতিহিংসার কারনে ৪দলীয় জোট সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠিত পূর্বধলা পৌরসভাটি তিনি বাতিল করেন। এ নিয়ে খোদ দলীয় লোকজনের মাঝে চরম ক্ষোভ থাকলেও তার ভয়ে কেউ মুখ খুলেনি। নিজে একজন বীরপ্রতীক হয়েও কতিপয় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহার করে টাকার বিনিময়ে অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নারী কেলেংকারীতেও তিনি ছিলেন আলোচনার শীর্ষে।

নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করলেও কেউ মুখফুটে কিছু বলতে পারেনি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন সংগ্রহ করলেও তিনি জমা দেননি। সেই থেকে তিনি পূর্বধলা উপজেলার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে অনেকটা আত্মগোপনে চলে যান। তবে আওয়ামী সরকারে পতনের পর সম্প্রতি তার নামে একটি হত্যা মামলা হলেও এখনো আটক না হওয়ায় অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে সাবেক সংসদ সদস্য ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীরপ্রতীকের ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বারে একাধিকভার কল দিলে মোবাইলটি বন্ধ পাওযা গেছে।

ভুক্তভোগী জামায়াত নেতা মঞ্জুরুল হক বলেন, এমপি বেলালের দৌরাত্বে এই ১৫ বছর জামায়াত নেতাকর্মীদের পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। কোন সাংগঠনিক কাজ করতে দেওয়া হয়নি। মিথ্যা-সাজানো মামলা দিয়ে শতশত নেতা কর্মীদের হয়রানি করা হয়েছে। রাতে বাসায় ঘুমোতে দেওয়া হয়নি। এ সকল অপরাধের কারনে তিনি এমপি বেলালের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দাবি করেন।

উপজেলা বিএনপির আহবায়ক বাবুল আলম তালুকদার বলেন, 'এমপি বেলালের স্বেচ্ছাচারিতায় ঠিকমত দলীয় কর্মসূচি পালন করতে পারিনি। উপজেলার বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের নামে প্রায় ৪০টির মত মিথ্যা, সাজানো মামলা দিয়ে পুলিশ দিয়ে প্রতিনিয়ত হয়রানী করেছেন।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে