বিভিন্ন অঞ্চলে চলতি মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ জমিতে উন্নত জাতের সরিষা চাষ হয়েছে। বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠজুড়ে এখন হলুদের সমারোহ। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে অধিক ফলনের স্বপ্ন বুনছেন কৃষক ও কৃষি বিভাগ। প্রতিনিধিদের পাঠানো বিস্তারিত খবর-
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠজুড়ে বাতাসে দোল খাচ্ছে সরিষা ফলের হলুদের সমারোহ। গত বছর স্থানীয় বাজারে উন্নত জাতের সরিষার চাহিদা ও দাম ভালো পাওয়ায় কৃষকরা এবার সরিষা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর সদর উপজেলায় ৩ হাজার ৮২৫ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৩৫৫ মেট্রিক টন। বেশিরভাগই জমিতে উচ্চ ফলনশীল বারি সরিষা-১৪ ও টরি-৭ জাতের সরিষা চাষ করেছেন। চলতি মৌসুমের শুরুতে উপজেলা কৃষি বিভাগ অধিক ফলনশীল বারি সরিষা-১৪ ও টরি-৭ জাতের সরিষা চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেন। সরিষা মাত্র ৭০-৭৫ দিনে ঘরে তোলা যায়। এ ছাড়া সরিষা সংগ্রহের পর ওই জমিতে আবার বোরো আবাদ করা যায়।
জেলার ৬ উপজেলায় এ বছর সরিষার আবাদ হয়েছে ১২ হাজার ৮০ হেক্টর জমিতে। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার ৬০৬ হেক্টর। কৃষকরা বলছেন, সরিষা লাভজনক একটি ফসল। সরিষা চাষে আর্থিক খরচ ও শ্রম দু'টিই কম লাগে। ফলে দিনে দিনে সরিষার চাষ বাড়ছে এ জেলায়।
সরেজমিনে এলাকা পরিদর্শনে দেখা যায়, সদর উপজেলার ১৩নং ফুরসন্ধী ইউনিয়নের ভবানিপুর ফসলের মাঠগুলো সরিষা ফুলের হলুদ রঙে অপরুপ শোভা ধারণ করেছে। কোনো জমিতে তাজা সরিষা ফুল, কোনোটিতে ফুল ঝরতে শুরু করেছে। আবার কোনো স্থানে গাছে সরিষার দানা বাঁধতে শুরু করেছে।
ভবানিপুর গ্রামের চাষি আব্দুল লতিফ বলেন, এ বছর ৪ বিঘা জমিতে টরি-৭ জাতের সরিষার আবাদ করেছেন। বিঘা প্রতি ৩-৪ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আশা করছেন ফলন ভালো হবে।
একই এলাকার চাষি আসাদুজ্জামান জানান, চলতি মৌসুমে ৮ বিঘা জমিতে বারি সরিষা-১৪ জাতের উচ্চ ফলনশীল সরিষা চাষ করেছেন। যা থেকে ৮০ মণ সরিষা পাবেন বলে তার আশা। বর্তমানে প্রতিমণ সরিষা ৩০০০-৩৫০০ টাকা দরে ক্রয় বিক্রয় হচ্ছে। গত বছর ৮ বিঘা জমিতে খরচ খরচা বাদে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা লাভ হয়েছিল।
এ ব্যাপারে সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর-এ-নবী জানান, প্রতিবছর ভোজ্যতেল আমদানির পেছনে যে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয় তা কমিয়ে আনতে কৃষকদের সরিষার আবাদ বৃদ্ধির জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। উন্নতজাতের সরিষা চাষে কৃষকদের প্রণোদনার মাধ্যমে উপকরণ সহায়তাসহ নানা পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যার বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।
ঝিনাইদহ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ষষ্টী চন্দ্র রায় জানান, ভবিষ্যতে সরিষার আবাদ আরও বৃদ্ধি পাবে এবং অচিরেই ভোজ্য তেল আমদানি করা বাদেই সরিষা থেকে দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।
গাংনী (মেহেরপুর) প্রতিনিধি জানান, মেহেরপুরের গাংনীতে এবার সরিষা চাষের বিপস্নব ঘটেছে। কৃষকরা এখন সরিষা চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। কৃষি বিভাগ থেকেও সরিষা চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে চাষিদের। ফলে উপজেলার মাঠজুড়ে হাতছানি দিচ্ছে মনোমুগ্ধকর হলুদ রঙের সরিষা ফুল। এ দিকে সরিষা চাষ হওয়ায় অনেকেই মৌচাষ করছেন।
কৃষি বিভাগ বলেছে, সরিষা চাষিদের সর্বাত্মক পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া সরকারি প্রণোদনাও দেওয়া হয়েছে চাষিদের। অন্যদিকে চাষিরা বলছেন, চাষাবাদে অন্য ফসলের চেয়ে খরচ এবং শ্রম কম লাগে। অথচ ফলন ও লাভ বেশি। এদিকে সরিষার ফুল চাষি এবং লোকজনের কাছে আর্কষণীয় হওয়ায় অনেকে সখের বশেও আবাদ করছেন।
উপজেলা কৃষি অফিসের হিসেব মতে, গত মৌসুমে উপজেলায় ২৮৭৫ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছিল। এবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯৫০ হেক্টর জমিতে। যা গেল বছরের চেয়ে ৭৫ হেক্টর বেশি। আবাদ বাড়াতে সরকারিভাবে ২৫০০ জন চাষিকে প্রণোদনা হিসেবে বীজ ও সার দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও চাষিরা দেশী জাতের সরিষা আবাদ করছেন।
উপজেলার জুগিরগোফা গ্রামের কৃষক বারেক, রফিকুল, কামারখালি গ্রামের নবী উল্যাসহ কয়েকজন কৃষক জানান, সরিষা লাভজনক ফসল। দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে ফলন ওঠে। আমন ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে তারা জমি চাষ দিয়ে বীজ বপণ করেন। সরিষা উঠে গেলে ওই জমিতে অন্য শস্য আবাদ করতে পারবেন। তাই এ সময় অন্য ফসলের চেয়ে সরিষা চাষাবাদকে তারা উত্তম মনে করছেন।
কৃষি অফিসার ইমরান হোসেন জানান, এবার অন্যান্য মৌসুমে চেয়ে সরিষার আবাদ বেশি হয়েছে। কৃষি বিভাগ থেকে মাঠের চাষিদের পরামর্শ এবং সরকারি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
আত্রাই (নওগাঁ) প্রতিনিধি জানান, নওগাঁর আত্রাইয়ে এবার সরিষার বাম্পার ফলনের আশাবাদি কৃষক। এবার উপজেলার ৮ ইউনিয়নে ৫ হাজার ৩৬০ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। এর মধ্যে শাহাগোলা, কালিকাপুর ও হাটকালুপাড়া ইউনিয়নে সর্বাধিক জমিতে সরিসার চাষ করা হয়েছে। মৌসুমের শুরু থেকেই অনুকূল আবহাওয়া ও সঠিক পরিচর্যার কারণে মাঠে মাঠে সরিষার গাছ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
এবার সরিষা চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে সরকারীভাবেও ব্যাপক প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও উপজেলা কৃষি অফিস থেকে তাদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেওয়া হয়।
সরিষা একটি লাভজনক আবাদ। কম পরিশ্রম, স্বল্প সময়ে উৎপাদন এবং বাজারে যথেষ্ট চাহিদা থাকায় এবারে কৃষকরা ঝুঁকে পড়েছে সরিষা চাষে। কৃষকদের কাছ থেকে জানা যায়, ভালো ফলন হলে সরিষা বিঘা প্রতি ৮ থেকে ১০ মণ পর্যন্ত ফলন হয়। বর্তমান বাজারে ৩ হাজার ৫০০ টাকা মণ সরিষা বিক্রি হচ্ছে। সে অনুযায়ী একজন কৃষক বিঘা প্রতি ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা আয় করতে পারছেন। এদিকে সরিষা কর্তনের পর অধিকাংশ জমিতে বোরো চাষ করা হয়ে থাকে। তাই এটি কৃষকদের জন্য একটি বাড়তি আয়।
উপজেলার বড়শিমলা গ্রামের আব্দুল জলিল, চকশিমলা গ্রামের বেলাল কবিরাজ বলেন, এবারে তাদের চাষকৃত সরিষাগুলো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এলাকা জুড়ে যারা সরিষা চাষ করেছেন সবারই সরিষার জমি এখন হলুদ রঙে রঙিন হয়ে উঠায় যেন এগুলো বিনোদন স্পট হয়েছে। আবহাওয়ার বিপর্যয় না হলে বাম্পার ফলনেরও আশাবাদি তারা।
উপজেলা কৃষি অফিসার প্রসেনজিৎ তালুকদার বলেন, এবারে বিপুল সংখ্যক কৃষককে সরিষা বীজ ও সার প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বীজ নিয়ে যেন তারা প্রতারণার শিকার না হন এ জন্য বাজার পর্যায়ও তদারকি করা হচ্ছে। কৃষকরা যাতে স্বল্প খরচে অধিক ফলন পান। এ জন্য তাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
ভাঙ্গুড়া (পাবনা) প্রতিনিধি জানান, পাবনার ভাঙ্গুড়ায় বিগত মৌসুমে ৬হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছিল। চলতি মৌসুমে মোট ৬হাজার ৬৬০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির সরিষার আবাদ হয়েছে।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ জানিয়েছেন, সরকারিভাবে চলতি মৌসুমে উপজেলার ক্ষুদ্র-প্রান্তিক কৃষকদের উৎসাহিত করতে কৃষি প্রণোদনা হিসাবে ৮হাজার ৫৮৫ জন কৃষককে বিনামূল্যে উন্নত জাতের সরিষার বীজ এবং সার দেওয়া হয়েছে।
বিলপাড়ের গোপালপুর ও আদাবাড়িয়া সরিষা মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, জমির ফুলে ফুলে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত সময় পার করছে। উপজেলার মহিষবাথান গ্রামের আবু সামা জানান, প্রতি মণ সরিষার দাম ৪ হাজার টাকার কাছাকাছি। এ বছর বাজার পরিস্থিতি কৃষকদের আরও আশাবাদী করে তুলেছে। কৃষকরা আশা করছেন, সরিষার বাম্পার ফলন হবে।
উপজেলা পর্যায়ে প্রথম সারির সরিষা চাষি পুকুরপাড় গ্রামের আব্দুল সালাম ফকির, কয়ড়া গ্রামের আ. হাই, আলতাব হোসেন, জয়রামপুর গ্রামের আ. রহিম ও দুধবাড়িয়া গ্রামের কৃষক আবু সাঈদ বলেন, সরিষা চাষে খরচ ও পরিশ্রম দুই কম এবং বেশি লাভজনক। বর্তমান বিলাঞ্চলের কৃষকদের তেল জাতীয় ও লাভজনক ফসল হিসাবে সরিষা চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
ইতোমধ্যে উপজেলার বিভিন্ন মাঠে সরিষার জমিতে অর্ধশাতাধিক মৌখামার মধু সংগ্রহের জন্য মাঠে মাঠে স্থাপন করা হয়েছে। খানমরিচ ইউপির মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিখিল কুমার বর্মণ জানান, অধিকাংশ সরিষা ক্ষেতে কৃত্রিম মৌখামার স্থাপনের ফলে সরিষা ফুলের পরাগায়নে সহযোগিতায় ফলন বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন জাহান জানান, মৌসুমের শুরুতে পর্যাপ্ত সার-বীজ, পরবর্তীতে অনুকূল পরিবেশ, কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সরিষা চাষে বিশেষ দিগনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবছর প্রতি বিঘায় ৬-৭মণ সরিষার ফলন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি জানান, খুলনার পাইকগাছায় চলতি মৌসুমে ৩২০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। কৃষি অফিস থেকে বিনামূল্যে কৃষকদের সরিষার বীজ ও সার দেওয়ায় আবাদ বেড়েছে। তবে সময় মত মাটিতে জো না আসায় সরিষার আবাদ কিছুটা দেরি শুরু হয়। উপকূলের লবনাক্ত এলাকা চাষাবাদ অনেকটা প্রকৃতি ও আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে। অন্য এলাকায় আগাম মাটিতে জো আসলেও উপকূল এলাকার নিচু মাটিতে জো আসতে দেরি হয়। উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে সরিষার চাষের উপযোগী ৪টি ইউনিয়ন গদাইপুর, হরিঢালী, কপিলমুনি ও রাড়ুলি সরিষার আবাদ হয়। আর চাঁদখালী, গড়ইখালী ও দেলুটিতে উচু এলাকার সামান্য জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। কৃষকরা বারি সরিষা ১৪,১৮ বিনা-৯ ও স্থানিয় জাতের সরিষা আবাদ করেছেন। উপকূলীয় উর্বর জমিতে এ বছর আশানারুপ সরিষা উৎপাদন হবে বলে কৃষকরা আশা করছেন।
উপজেলার গোপালপুর গ্রামে সরিষা চাষি আনছার আলী, আব্দুস সামাদ, হিতামপুর বস্নকের জিয়া সরদার ও সলুয়ার শহিদ জানান, তাদের ক্ষেতের আবাদকৃত সরিষা ভালো হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ একরামুল ইসলাম জানান, ধান কাটতে দেরি হওয়ায় সরিষা আবাদ করতে কিছুটা দেরি হয়েছে। কৃষকরা যদি আগাম জাতের ধান চাষ করে তাহলে ধান কাটার পর সময়মত সরিষা চাষে সময় পাবেন। কৃষকদের আগাম জাতের ধান চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এ বছর উপজেলায় সরিষার আবাদ ভালো হয়েছে। প্রাকৃতিক কোন বিপর্যয়ের না হলে আশানুরুপ ফলন পাওয়া যাবে।