সময়ের পরিবর্তনে আধুনিকতার বেড়াজালে ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়িদের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁত শিল্প। এ ঐতিহ্য বিলুপ্ত হওয়ার পেছনে শিল্পে ব্যবহৃত বনজ সরঞ্জাম ও কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতাকেও দায়ী করছেন কাজের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা।
পাহাড়ি এলাকায় শীতের সকালে বাড়ির উঠানে সোনালী রোদে কোমর তাঁতে পরিবারের প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় বুনতেন নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা। এক সময় প্রায় প্রতিটি পাহাড়ি পলস্নীর বাড়ির উঠানে কাপড় বোনার এ দৃশ্য খুব বেশি পরিচিত ছিল। দূর্গম পাহাড়ি পলস্নীর কোন কোন বাড়িতে চোখে পড়লেও শহুরে বসতিতে এখন এমন দৃশ্যের দেখা পাওয়া বিরল।
জুমে উৎপাদিত কার্পাস তুলার চরকায় তৈরি করা সুতা বুনো গাছ-গাছালি থেকে নিসৃত কস বা রস ব্যবহার করে বিভিন্ন রঙে রঙিন করা হতো। আর বিশেষ জাতের বনজ গাছের কাঠ ও বাঁশের তৈরি সরঞ্জাম দিয়ে রঙিন সুতায় বুনা হয় কাপড়। কোমরে বেঁধে কাঠ ও বাঁশের সরঞ্জামে কাপড় বুনা হয় বলে এর নাম কোমর তাঁত।
চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তংচঙ্গ্যাসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সকল সম্প্রদায়ই কোমর তাঁতে পরিবারের বস্ত্র তৈরি করতো। অবশ্য প্রত্যেক সম্প্রদায়ের তৈরি বস্ত্র সামগ্রীর আলাদা নকশা, রঙ ও নাম রয়েছে। কোমর তাঁতে কাপড় বুনার ঐহিত্য শতশত বছরের পুরনো। সেই সময় থেকেই পাহাড়ি নারীরা নিজেদের পড়নের কাপড় নিজেরাই বুনতেন। কোমর তাঁতেই বুনা হতো এসব কাপড়। একটা সময় কোমর তাঁতে কাপড় বুনার সক্ষমতাই ছিল বিয়ের পিড়িতে বসা কনের মূল যোগ্যতা।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বেশিভাগই জুম চাষে নির্ভরশীল। নারীরা ঘরের কাজের পাশাপাশি কৃষিকাজ করেন। অবসরে কোমর তাঁতে কাপড় বুনেন। সেই ঐতিহ্য এখন আর নেই। দুর্গম পলস্নী-গ্রামের নারীদের হাত ধরেই এখনো যেটুকু আছে এই শিল্প।
কোমর তাঁতের কারিগররা জানান, বন উজাড়ের কারণে আগের মত জঙ্গলে সরঞ্জাম তৈরির বিশেষ জাতের কাঠ ও বাঁশ পাওয়া যায় না। জুম চাষও কমে গেছে। কার্পাস তুলা বা সুতা রঙ করার সেই গাছ-গাছালিও নেই। এছাড়া সনাতনী পদ্ধতিতে তুলা থেকে সুতা তৈরিও সময় সাপেক্ষ। তাই কোমর তাঁতের প্রযুক্তি সরঞ্জাম, কাঁচামাল সব কিছুই বাজার থেকে কিনতে হয়। আর বাজারে সুতাসহ প্রায় সব ধরনের উপকরণের দামই বেড়েছে। তাই এখন কাপড় তৈরি করে লাভবান হওয়া দুষ্কর।
প্রভাতী ত্রিপুরা নামে একজন সৌখিন কোমর তাঁতি বলেন, বর্তমান বাজারে পাহাড়ি নারীর হাতে তৈরি একটি শীতের কম্বল বিক্রি করা যায় ৪০০-৮০০ টাকা। এমন একটি কম্বল তৈরিতে উল কিনতে হয় প্রায় সাড়ে ৩০০-৪০০ টাকার। এছাড়া উল কিনে মার দেয়া, টানা দেয়া, শুকানো এবং বুননে যে সময়, শ্রম ও মেধা ব্যয় করতে হয় তাতে পারিশ্রমিক উঠে আসে না।
সিমা চাকমা নামে আরেক গৃহবধূ বলেন, এটি আমাদের চাকমাদের ঐতিহ্য। যুগ যুগ ধরে আমরা কাপড় বুনন করে আসছি কোমর তাঁত দিয়ে। এখন বাজার থেকে সুতা কিনে কাপড় তৈরি করব, সেই সামর্থ্য নেই। সুতার দাম বাড়তি। তাই সরকার আমাদের কম-মূল্যে সুতা দিলে উপকৃত হবো।
পাহাড়ি নারী নেত্রী শেফালিকা ত্রিপুরা জানান, এখানকার লোকজন যতই পড়ালেখা শিখছে, ততই ভুলছে নিজের ঐতিহ্য গাঁথা। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সবকিছু ভুলে যাওয়া ঠিক নয়; তাতে ভবিষ্যৎ ভালো হয় না। তিনি বলেন, 'শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমি নিজের জন্য, পরিবারের জন্য কোমর তাঁতে কাপড় বুনি। নিজে ব্যবহার করি। প্রতিবেশী, স্বজন ছাড়াও গরীবদেরও দিই। এ শিল্প বাঁচাতে হলে, পাহাড়িদের মধ্যে আগের মত আগ্রহ-উৎসাহ বাড়াতে হলে সবচেয়ে বেশি দরকার পূঁজির যোগান দেওয়া। এ ক্ষেত্রে সুদমুক্ত বা স্বল্প সুদ ও তা সহজলভ্য করলে অনেকেই এগিয়ে আসবে। এছাড়া বাজারজাত করারও সুযোগ করে দিতে হবে।'
মারমা উন্নয়ন সংসদের কেন্দ্রীয় সভাপতি মংপ্রু চৌধুরী বলেন, আধুনিকতার মোহে পাহাড়িদের অনেক ঐতিহ্য, সংস্কৃতির মত কোমর তাঁতও ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে চলেছে। অবশ্য মারমা সংসদসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এসব ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য সচেতনতামূলক কাজ করছে। তিনি বলেন, এসব সংস্কৃতি-ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারেরও দায়িত্ব আছে। কোমর তাঁত রক্ষায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বিভাগের ভূমিকা আবশ্যক।'
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) খাগড়াছড়ির উপ-ব্যবস্থাপক মো. আলী আল রাজী বলেন- বিশেষত, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বহু নারীকে উল-সুতা ও তাঁত সহায়তা দেয়া হতো। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে উৎপাদিত পণ্য বিসিক কিনে এনে তা ১০ শতাংশ লাভে বিক্রি করার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে প্রকল্পটি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া বিসিকের আশির দশকে চালু হওয়া সিআরআইডিপি মাঝ পথে বন্ধ হওয়ায় প্রশিক্ষণসহ অনেক সরকারি সহায়তাই এখন আর নেই।'
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বিসিকের মাধ্যমে ফ্রেম তাঁত ও গর্ত তাঁতের প্রশিক্ষণ, উৎপাদন কার্যক্রম চলছে। কিন্তু কোমর তাঁত নিয়ে তাদের কোন কার্যক্রম নেই।' তাই পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে!