শীত মৌসুম ঘিরে প্রতি বছরের মত এবারো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে চলছে লালি উৎপাদনের ধুম। আঁখের রস থেকে উৎপাদিত হচ্ছে সুস্বাদু রসালো গুড় লালি। পিঠা, পুলিতে খেতে লালির কদর বেশ। দুধে মিশিয়েও খাওয়া যায়। লালি ছাড়া পিঠা-পুলির স্বাদ যেন অনেকটাই ফিঁকে ভোজন বিলাসীদের কাছে। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ১০-১২ জন উদ্যোক্তা বছরের কার্তিক মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করে লালি উৎপাদনে।
চোখ বাঁধা মহিষ ঘুরছে। কাঁধে বাঁশ বাঁধা। ঘুরছে একটি যন্ত্র। আর তাতে আখ পিষে বের হচ্ছে রস। সেই রস আগুনের তাপে হচ্ছে বিশেষ গুড়, যার নাম লালি হিসেবে পরিচিত। লালি উৎপাদনে ১৫-২০টি মহিষকে এ কাজে লাগানো হয়। মহিষের এই শ্রমে তৈরি হয় প্রায় কোটি টাকার বেশি লালি। মূলত শীতের মৌসুমে এ লালি উৎপাদন করা হয়। পিঠা, পুলিতে খেতে লালির কদর বেশ। দুধে মিশিয়েও খাওয়া যায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণপুর গ্রামে এখন এখন লালি তৈরির ধূম। গ্রামটি ধীরে ধীরে লালির গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। গ্রামে মোট আটটি ঘানিতে লালি তৈরি হয়। তবে আঁখ চাষ কমে যাওয়ায় লালি তৈরির ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেনে সংশ্লিষ্টরা।
উপজেলা কৃষি অফিস সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলায় ২০ থেকে ২৫ হেক্টর জমিতে আখের চাষ হয়। আর এসব জমিতে দুই হাজার মেট্রিক টনের বেশি আখ উৎপাদন হয়ে থাকে। এসব আখের বেশিরভাগ লালি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রায় এক কোটি টাকা মূল্যের ১০০ মেট্রিক টন লালি বিক্রির ধারণা পাওয়া যায় সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে।
জেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম বিষ্ণুপুর গ্রাম। বিষ্ণুপুর বাজার থেকে ভারত সীমান্তঘেঁষা কালাছড়া গ্রামে যাওয়ার সড়কের পাশেই দেখা যায় মহিষের ঘানিতে লালি তৈরির কর্মযজ্ঞ। সবগুলো ঘানিই সড়কের পাশে।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তিন-চারজন ব্যস্ত লালি তৈরিতে। কেউ ঘানি টানার কাজ করছেন। মহিষ যেন তার কথামতো ঘানি টানার কাজ করছে। কেউ ব্যস্ত আঁখ প্রস্তুত করতে। কেউবা ব্যস্ত আগুনে আখের রস জ্বাল দিতে। লালিন তৈরিতে খড়কুটো হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে রস বের করে ফেলে রাখা আঁখের উচ্ছিষ্ট।
লালি তৈরির শুরু থেকে শেষ নাগাদ সময় লাগে প্রায় পাঁচ ঘন্টা। এক কেজি লালির দাম পড়ে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা। এছাড়া আঁখের রস বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি ধরে। ভোর থেকে শুরু হয় এ কর্মযজ্ঞ। দেখা মিলে বেশ কয়েকজন ক্রেতারও। গ্রামে ঢোকার পর প্রথম ঘানির কাছে ভোর থেকেই কয়েকজন বসে আছেন লালি নেওয়ার জন্য। মূলত লালি তৈরির প্রক্রিয়া দেখতে তাদের একটু আগেভাগে আসা।
লালি উৎপাদনের কারিগর মো. শাহনেওয়াজ জানান, চারজন মিলে পুঁজি দিয়ে তারা ব্যবসা করছেন। শীতের তিন-চার মাস তারা লালি তৈরি করেন। আগে থেকেই আঁখের ক্ষেত তারা কিনে নেন। এছাড়া একাধিক মহিষ কিনতে তাদের পুঁজি লাগে। দুর দূরান্ত থেকে লোকজন এসে এখান থেকে লালি নিয়ে যান। কেউ ইচ্ছা করলে আঁখের রসও নিতে পারেন।
উপজেলার ভিটি দাউদপুর গ্রামের মো. ইয়াছিন নামে এক ক্রেতা বলেন, এখানে ভেজালমুক্ত লালি বিক্রি হয় বলে নিতে এসেছেন। পাঁচ-ছয় কেজি লালি তিনি নিবেন। কিভাবে লালি তৈরি হয় দেখতে ভোরে চলে এসেছেন।
মো. হোসেন নামে এক ব্যক্তি বলেন, 'আমারও আঁখের ক্ষেত ছিল। তখন থেকেই এখানে লালি তৈরি হওয়ার বিষয়টি জানি। শীতের সময় লালি দিয়ে পিঠা খেতে খুব স্বাদ লাগে। তাই এখান থেকে সব সময়ই লালি নিতে আসি।'
বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল অদুদ বলেন, এবারও শীত মৌসুমে কোটি টাকার লালি বিক্রি হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এখন পুরোদমে লালি তৈরি হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপ-পরিচালক সুশান্ত সাহা জানান, চলতি মৌসুমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রায় কোটি টাকার লালি বিক্রি হবে। লালির উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণসহ আঁখের নতুন জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণে কাজ করছে কৃষি বিভাগ।