তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের সময় রংপুর-বগুড়া মহাসড়ক হতে ১০ কি.মি. পূর্বে ৩৫ একর জমির মধ্যে মহিমাগঞ্জ রংপুর সুগার মিলস্ লি: নামে একটি চিনিকল স্থাপনের কাজ শুরু হয়। করতোয়া নদীর অববাহিকায় ১৯৫৭ সালে কারখানাটির স্থাপনার কাজ শেষ হয়। ১৯৫৭-৫৮ সেশনে চিনি উৎপাদন শুরু হয় এই চিনিকলে। চিনিকলটির দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ১৫০০ মে. টন। চিনিকলটি গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কৃষি জমি আখ চাষের উপযোগী বলে ভারি শিল্পটি এ অঞ্চলে গড়ে ওঠে। চিনিকলের আওতায় খামারের জমির পরিমাণ ১৯৮২.২০ একর। আঁখ চাষের উপযোগী জমির পরিমাণ ৩৯০০০ একর বলে জানা যায়। আঁখ সাবজোনের সংখ্যা ৮টি এবং ক্রয় কেন্দ্র সংখ্যা ৪২টি। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের আওতায় রংপুর চিনিকল লিমিটেড বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান। এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান একটি চিনিকল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। চিনি, জৈব সার, চিটাগুড় ও মন্ড উৎপাদন হতো এ শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে। বাণিজ্যিক অঞ্চল ছিল বিশ্বব্যাপী। এখানকার পাওয়ার হাউজে উৎপাদিত বিদু্যৎ রেল স্টেশন সহ বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হতো। আঁখ পরিবহনের জন্য ছিল নিজস্ব রেলপথ। নিজস্ব রেল পরিবহন করা হতো উৎপাদিত পণ্য। চিনিকলের সুবাদে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয় মহিমাগঞ্জ। রংপুর চিনিকল উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী ভুমিকা পালন করে। আঁখ চাষী সহ চিনিকলের শ্রমিক কর্মচারীদের জীবিকার পথ সৃষ্টি করেছিল রংপুর (মহিমাগঞ্জ) চিনিকল। চিনিকলের শ্রমিক কর্মচারী ও অত্র এলাকার আঁখ চাষীদের অভিযোগ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং একমুখী শিল্পনীতির কারণে ২০২০-২১ সালে মৌসুমের শুরুতে বিপুল পরিমাণ আঁখ জমিতে রেখে চিনিকল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। প্রায় ১২ হাজার শ্রমিক কর্মচারী ও কর্মকর্তা এবং ৫০ হাজার চাষী ছাড়াও লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা অর্জনের মাধ্যম ছিল এই চিনিকলটি। অর্ধসহস্রাধিক শ্রমিক রুটি রুজির জন্য রিক্সা-ভ্যান চালিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। দীর্ঘদিন চিনিকলটি বন্ধ থাকায় কারখানা চত্বরে ভরে গেছে ঝোঁপ-ঝাঁড়ে। খোলা আকাশের নিচে অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা পরিবহনগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। মূল্যবান যন্ত্রপাতিতে এখন শুধুই মরিচা লক্ষ্য করা যায়। কারখানার সাথে সংশ্লিষ্ট আঁখ চাষী শ্রমিক কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের দৈনন্দিন চিরচেনা দৃশ্যটি আর নেই। সবকিছু সুনশান। শত শত সারিবদ্ধ গাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণটি গোচারণ ভুমিতে রূপ লাভ করেছে। লোকসান কমাতে আধুনিকায়নের মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করতে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন যে ছয়টি চিনিকলে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করা হয় তারমধ্যে অন্যতম এই চিনিকলটি। ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ সালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চিনিকলের উৎপাদন স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের খবরে এলাকায় আঁখ চাষী সহ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের মাঝে প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। চিনিকলটি চালু হলে লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান হবে বলে অনেকেই মনে করেন। আঁখ চাষি মিঠু মিয়া বলেন, চিনিকল চালুর খবরে আমরা খুবই খুশি। জাঁকজমক হবে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ। তিনি আরও বলেন, চিনিকলটি চালু হলে আঁখ চাষীদের ভাগ্য খুলে যাবে। এ বিষয়ে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম গাইবান্ধা জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ও শিশু পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাড. শাহনেওয়াজ খান বলেন, বিগত সরকারের সময়ে দুর্নীতির কারণে চিনিকলটি বন্ধ হয়ে যায়। চিনিকলটির মাড়াই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার সরকারের মহতী উদ্যোগ। গাইবান্ধা জেলার এই ভারী শিল্পটি সচল রাখতে সরকারকে একমুখী শিল্পনীতি পরিহার করতে হবে। সেইসাথে দুর্নীতি রোধ করতে হবে। চিনিকলটি চালু হলে একদিকে যেমন বেকারত্ব ঘুঁচবে অপরদিকে আঁখচাষী, শ্রমিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ফিরে পাবে তাদের স্বপ্নের কর্মস্থল। তিনি এই চিনিকলের প্রতি উদার দৃষ্টি দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ইনচার্জ) মাছুমা আকতার জানান, এখানকার আবহাওয়া আঁখ চাষের উপযোগী। মিলটি চালু হলে লাভজনক অবস্থায় উন্নীত করা সম্ভব।