মানিকগঞ্জের শিবালয়ে ফসলি জমিতে মাটি কাটার কারনে প্রতি বছর প্রায় দুই হেক্টর করে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। ফলে দিন দিন ফসলেরও উৎপাদন কমছে। গত ২০১৫ সালে এ উপজেলায় ফসলি জমির পরিমান ছিল ১২ হাজার ৫৯৮ হেক্টর। গত ২০২৪ সালে (বর্তমানে) ফসলি জমির পরিমান কমে হয়েছে ১২ হাজার ৫৭৬ হেক্টর। গত ৯ কছরে ফসলি জমির মাটি কেটে ও ইট ভাটা নেওয়াসহ বিভিন্ন স্থাপনার কারনে ফসলি জমি কমেছে ২২ হেক্টর। ফলে ফসলি জমি কমে যাওয়ার কারনে প্রতি বছর ফসলের উৎপাদনও কমে যাচ্ছে কৃষকদের।
গত ২০২০ সালে ফসলি জমির পরিমান ছিল প্রায় ১২ হাজার ৫৭০ হেক্টর। সরিষা, পিয়াজ, রসুন, আলু, ভুট্টা ও বোরোসহ বিভিন্ন ফসলের লক্ষমাত্রা ছিল ১৭ হাজার ৫৬৬ হেক্টর। উৎপাদন হয়েছে সরিষা ৬হাজার ৭১৬ হেক্টর, মাসকালাই ১৮৫ হেক্টর, খেশারি ৫৯ হেক্টর, মুশুরি ১৮ হেক্টর, গম ২০১ হেক্টর, আলু ১৪৪ হেক্টর, মিষ্টি আলু ২৫৩ হেক্টর, পিয়াজ ৩২হাজার ৭৭ হেক্টর, রসুন ২হাজার ৫ হেক্টর, মরিচ ১৬ হাজার, ৩২৮ হেক্টর, সনিয়া ৩৫ হেক্টর, ভুট্রা ৩হাজার ৯৫১ হেক্টর, চিনাবাদাম ১৩৬ হেক্টর, বোরো ৫০ হাজার ৭৯৪ হেক্টর, পাট ৪৪৩ হেক্টর, বোনা আমন ধান ৮হাজার ৬৩৬ হেক্টর।
গত ২০২১ সালে ফসলি জমির পরিমান ছিল প্রায় ১২ হাজার ৫৬২ হেক্টর ও বিভিন্ন ফসলের লক্ষমাত্রা ছিল ১৭ হাজার ৩০৪ হেক্টর এবং উৎপাদন হয়েছে সরিষা ৫হাজার ৪৮৩ হেক্টর, মাসকালাই ২৬ হেক্টর, খেশারি ৫৫ হেক্টর, মুশুরি ৬ হেক্টর, গম ৩৭ হেক্টর, আলু ৮০৪ হেক্টর, মিষ্টি আলু ১০৬ হেক্টর, পিয়াজ ৩৯হাজার ৩০৮ হেক্টর, রসুন ২হাজার ৮০২ হেক্টর, মরিচ ১০হাজার ৩৪৭ হেক্টর, ধনিয়া ২ হেক্টর।
গত ২০২২ সালে ফসলি জমির পরিমান ছিল ১২ হাজার ৫৬০ হেক্টর ও ফসলের লক্ষমাত্রা ছিল ১৯হাজার ৫৭৫ হেক্টর এবং উৎপাদন হয়েছে সরিষা ১০ হাজার ৫০৮ হেক্টর, মাসকালাই ২০৪ হেক্টর, খেশারি ৫১ হেক্টর, মুশুরি ১৩ হেক্টর, গম ৯৪ হেক্টর, আলু ৭০১ হেক্টর, মিষ্টি আলু ২০৩ হেক্টর, পিয়াজ ৩৯হাজার ৩৮১ হেক্টর, রসুন ১৮৩৮ হেক্টর, মরিচ ১০হাজার ৭৭৪ হেক্টর, ধনিয়া ৩২ হেক্টর।
গত ২০২৩ সালে ফসলি জমির পরিমান ছিল ১২হাজার ৫৫৮ হেক্টর ও ফসলের লক্ষমাত্রা ছিল ২৩ হাজার ৪১ হেক্টর এবং উৎপাদন হয়েছে সরিষা ১৫ হাজার ২৯১ হেক্টর, মাসকালাই ২০৩ হেক্টর, খেশারি ৫৩ হেক্টর, মুশুরি ১৩ হেক্টর, গম ৯১ হেক্টর, আলু ৯৩২ হেক্টর, মিষ্টি আলু ২৯০ হেক্টর, পিয়াজ ৪৭ হাজার, ৮৮০ হেক্টর।
যদিও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন ফসলি জমিতে পুকুর খনন ও ইটভাটায় মাটি বিক্রির কারনে ফসলি জমি কমছে। তবে জমিতে প্রতি বছর উন্নত জাতের বীজ রোপণ করার কারনে আগের তুলনায় ফসল উৎপাদন কমেনি।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছে না ফসলি জমির মাটি কাটা। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় দুর্নীতিবাজ একটি মহল দিনরাত মাটি কেটে যাচ্ছে। গ্রামীন সড়কে মাটি ভর্তি ট্রাক বা হাইট্রলি চলাচল করায় নির্মাণ বা রাস্তা সংস্কারের ২-৩ বছরের মধ্যেই ভেঙে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। মাঝে মধ্যে উপজেলা প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করে ভেকু ভেঙ্গে দিলেও রহস্য জনক কারনে দুই এক দিনের মধ্যেই আবার চালু হচ্ছে। প্রশাসনকে আমলেই নিচ্ছেন না মাটি ব্যবসায়ীরা।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আইন অমান্য করে এক্সক্যাভেটর (ভেকু) দিয়ে ফসলি জমির টপ সয়েল কাটা হচ্ছে। মাটি ব্যবসায়ীরা এ মাটি বিক্রি করছেন স্থানীয় ইটভাটাগুলোতে। মাটি ব্যবসায়ীরা বর্ষা মৌসুম শেষে ইটভাটার মালিকদের সঙ্গে আগেই চুক্তি করে রাখেন। উপজেলায় ৪টি ইটভাটা রয়েছে। ভাটাগুলো ফসলির জমির মধ্যে হওয়ায় মাটি দিতে সমস্যা হচ্ছে না ব্যবসায়ীদের। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ফসলি জমির টপ সয়েল কেটে ট্রাক দিয়ে নিয়ে এসব ভাটায় ইট প্রস্তুতের জন্য স্তূপ করে রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে গ্রামীন সড়কে মাটিভর্তি ট্রাক বা হাইট্রলি চলাচল করায় নির্মাণ বা সংস্কারের পর দুই-তিন বছরের মধ্যেই রাস্তা ভেঙে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। উপজেলার ফলসাটিয়া গ্রামের কৃষক দুলাল হোসেন, কিছু কৃষককে বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে তিন ফসলি জমির সয়েল মাটি ক্রয় করে ইটভাটায় নেওয়ার কারনে দিন দিন জমির উর্বরা শক্তি কমে যাচ্ছে। একারনে জমিতে ফসলও আগের তুলনায় কম হচ্ছে। আবার অনেকে পুকুর খনন করে মাটি বিক্রি করছেন। এতে দিন দিন ফসল উৎপাদন কমে যাওয়ায় এ উপজেলায় ফসলের ঘাটতি হচ্ছে। উলাইল ইউনিয়নের কুষ্টিয়া গ্রামের রাকিব হোসেন, 'আমাদের গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে প্রতি দিন ফলসাটিয়া ইটভাটায় মাটির ট্রাক আনা নেওয়া করার কারনে রাস্তা ভেঙে যাচ্ছে। নিষেধ করলে আমাদের মিথ্যা মামলার ভয় দেখানো হয়।' উপজেলার বেলতা গ্রামের কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, বেলতা ফসলি মাঠে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। ওই ফসলি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় নেওয়ার সময় গ্রাম্য রাস্তা ভেঙে যাচ্ছে। প্রশাসনের লোকজনকে জানিয়েও কোন লাভ হয়নি। মহাদেবপুর ইউনিয়নের ফলসাটিয়া মেসার্স রাহাত ব্রিকসের ম্যানেজার নাছির উদ্দিন বলেন, 'আমরা কৃষকদের কাছে থেকে জমির মাটি দালালদের মাধ্যমে কিনি। আমরা সড়কের ক্ষতি করছি না। সড়কের ক্ষতি হলে ঠিক করে দিচ্ছি।'
উপজেলা প্রকৌশলী ইসমাইল হোসেন বলেন, গ্রামীন সড়ক দিয়ে ট্রাক চলাচল করায় সড়ক ভেঙে যাওয়ার ব্যাপারে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা কৃষি অফিসার রাজিয়া তরফদার বলেন, 'এ উপজেলায় কৃষি জমির পরিমান ১২হাজার ৫৭৬ হেক্টর। তবে গত ২০১৫ সাল থেকে গত ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ৯ বছরে ফসলি জমির মাটি কাটার কারনে কমেছে ২২ হেক্টর ফসলি জমি। প্রতি বছর ফসলি জমিতে পুকুর খনন ও ইটভাটায় মাটি বিক্রির কারনে প্রায় ২ হেক্টর করে ফসলি জমি কমলেও উন্নত জাতের বীজ রোপণ করার কারনে আগের তুলনায় ফসলের ঘাটতি হচ্ছে না। এছাড়া, আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারি না।'
উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাকির হোসেন বলেন, কৃষি জমি থেকে কোনভাবেই মাটি কাটা যাবে না। কৃষি জমি থেকে কেউ যাতে মাটি কাটতে না পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।