শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২

কুমিলস্নার আঞ্চলিক সড়কগুলো এখন বিষফোঁড়া

ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকছে যানবাহন ৬ উপজেলার কয়েক লাখ মানুষের দুর্ভোগ
স্বদেশ ডেস্ক
  ০৭ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
কুমিলস্নার আঞ্চলিক সড়কগুলো এখন বিষফোঁড়া
কুমিলস্নার তিতাসে অবৈধ স্থাপনার কারণে প্রতিদিন লেগে থাকা যানজট -যাযাদি

কুমিলস্নার আঞ্চলিক সড়কগুলো এখন যানজটের বিষভোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে গৌরীপুর-বাঞ্ছারামপুর সড়ক, তিতাসের বাতাকান্দি-কড়িকান্দি-গৌরীপুর বাজার সড়ক এবং কুমিলস্না-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে অসহনীয় যানজটে চরম দুর্ভোগে মানুষ। এসব রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হচ্ছে ছয় উপজেলারকয়েক লাখ মানুষকে। কেই সময় মত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন না। এ ছয় উপজেলার মানুষ যানজট নিরসনে দ্রম্নত কার্যকরী পদক্ষেপ কামনা করছেন। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-

তিতাস (কুমিলস্না) প্রতিনিধি জানান, কুমিলস্নার গৌরীপুর-বাঞ্ছারামপুর ৩০ কিলোমিটার আঞ্চলিক সড়কের যানজটের বিষফোঁড়া তিতাসের বাতাকান্দি ও কড়িকান্দি বাজার এবং দাউদকান্দির গৌরীপুর বাজার। প্রতিদিন এই সকল স্থানে যানজটে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থাকছে যানবাহন। বিশেষ করে রোববার গৌরীপুর বাজারে ও বুধবার বাতাকান্দি বাজারে সাপ্তাহিক হাট থাকায় যানজট যেন আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ফলে কুমিলস্নার তিতাস, মেঘনা, হোমনা, মুরাদনগর, দাউদকান্দি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এই ছয়টি উপজেলার সব শ্রেণি-পেশার মানুষের এবং দূরপালস্নার বাস ও অন্যান্য যানের প্রধান সড়ক এটি।

জানা গেছে, ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে ১৯৯৪ সালে গৌরীপুর-তিতাস-হোমনা-বাঞ্ছারামপুরের ৩০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়। নদীমাত্রিক এলাকা হওয়ায় এই সড়কে তৎকালিন প্রায় ১৩টি বেইলি ব্রিজ স্থাপন করা হয়। বর্তমানে এসব স্থানে পাকা সেতু নির্মাণ শোভা পাচ্ছে। এই সড়কটি ব্যবহার করে কুমিলস্নার তিতাস, মেঘনা, হোমনা, মুরাদনগর, দাউদকান্দি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের মানুষ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে। সড়কটি নির্মাণের সময় সড়ক ও জনপদ (সওজ) বিভাগ বাজার এলাকায় রাস্তার দুই পাশে ৩০০ ফুটেরও বেশি জায়গা অধিগ্রহণ করে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিগত ২০ বছরে ৩০ কিলোমিটার সড়কের উভয়পাশে অসংখ্য সংযোগ রাস্তা স্থাপন হওয়ায় স্টেশনগুলোতে তৈরি হয়েছে অবৈধ সিএনজি ও অটোরিকশা স্ট্যান্ড। ফুটপাত দখল করে যানবাহনের স্ট্যান্ড তৈরি হওয়ায় যানজন আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে। আধা কিলোমিটার সড়ক অতিক্রম করতে ৩ থেকে ৪ ঘন্টা পর্যন্ত সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। এছাড়াও বাজার এলাকায় রাস্তা সরু হওয়ায় এবং ফুটপাতে ভাস্যমান দোকান থাকায় প্রতিদিন ঘন্টার ঘন্টা যাত্রীদের বসে থাকতে হচ্ছে।

তিতাসের কড়িকান্দি বাজারের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী সড়ক ও জনপথের জায়গা দখল করে দোকান ঘর নির্মাণ করেছে। তার উপর রাস্তার মধ্যে সিএনজি স্ট্যান্ড থাকার কারণে দুইটি গাড়ি পাশাপাশি যেতে পারছে না। এতে করে প্রতিদিনই ঘন্টার পর ঘন্টা যানজট লেগে থাকছে। বিশেষ করে তিতাসের বাতাকান্দি বাজারে বুধবারের সাপ্তাহিক হাটে গৌরীপুর বাজারের মতো যাত্রীদের ৩-৪ ঘন্টা যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে।

ওই সড়কের সিএনজি চালক লিয়াকত আলী জানান, 'গৌরীপুর যেতে ও আসতে আমাদের অতিরিক্ত এক থেকে দুই ঘন্টা ব্যয় হচ্ছে। বিশেষ করে গৌরীপুর, কড়িকান্দি ও বাতাকান্দি বাজারে প্রতিদিনই যানজট লেগে থাকে। এই যানজটের কারণে আমাদের আয় অনেক কমে গেছে।'

ট্রাকচালক হুমায়ুন কবির জানান, 'সপ্তাহে চার দিন আমরা এই সড়ক ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পণ্য নিয়ে যাই এবং নিয়ে আসি। কিন্তু যানজটের কারণে আমাদের সময় এবং খরচ দুটোই বেড়ে গেছে।'

সড়ক ও জনপথ বিভাগের গৌরীপুর অঞ্চলের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া জানান, 'আমরা বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উচ্ছেদ অভিযান শেষ হলে আমরা ওই সড়কটিতে পুলিশ ও প্রশাসনের সহযোগিতা উচ্ছেদ অভিযান চালাব।'

লাকসাম (কুমিলস্না) প্রতিনিধি জানান, তীব্র যানজটের ফলে কুমিলস্না-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের চার লেন এখন যানবাহন ও মানুষ চলাচলে বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাকসাম বাইপাস এবং বাগমারা বাজারে চার লেনের কাজ না হওয়ার ফলে দুই লেনের ওই সড়কে তীব্র যানজটে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকা পড়ছে যানবাহনসহ সাধারণ মানুষ। অসহনীয় ও তীব্র যানজটে নাকাল যানবাহন চালক, যাত্রীসহ পথচারীরাও।

জানা যায়- ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার অংশের কাজ বাকি রেখেই কুমিলস্না-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের কুমিলস্না নগরীর টমছমব্রিজ থেকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ পর্যন্ত ৫৯ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেন প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করে সওজ। মূলত এ কারণেই এখন যানজটের চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীসহ সাধারণ মানুষ।

কুমিলস্না-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের চালক, যাত্রী ও সাধারণ মানুষের কাছে এ চার লেন সড়ক এখন বড় বিষফোঁড়ায় পরিনত হয়েছে। ওই চার লেন প্রকল্পের কুমিলস্নার লালমাই উপজেলার বাগমারা বাজার এলাকা, শানিচৌঁ, কাঁচিকাটা ও লালমাই উপজেলার দক্ষিণ সীমান্ত ফয়েজ গঞ্জ এম, আর ফিলিং স্টেশন থেকে শুরু করে লাকসাম পৌরসভার মিশ্রী, রেলওয়ে জংশন এলাকা, নশরতপুর, চাঁদপুর রেলগেইট, দৌলতগঞ্জ বাইপাস, দক্ষিণ লাকসাম, ধামৈচা এবং লাকসাম উপজেলার উত্তরদা ইউনিয়নের চন্দনা বাজারসহ পুরো এলাকায় ৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার অংশের কাজ এখনো দুই লেনে রয়েছে। ফলে এ দুই লেনের এলাকাগুলোয় যানজটের কবলে পড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা যানবাহন আটকে নাভিশ্বাস যাত্রীসহ সাধারণ মানুষের।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, লালমাই উপজেলার বাগমারা বাজারের উত্তরে গার্লস হাইস্কুল থেকে শুরু করে বাগমারা বাজারের শেষ দক্ষিণ এলাকা পর্যন্ত এবং লাকসামের জংশন এলাকা থেকে শুরু করে দক্ষিণ বাইপাস পর্যন্ত এলাকাগুলো অতিক্রম করা যানবাহনের চালক ও যাত্রীদের জন্য বর্তমানে বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাগমারা বাজার এলাকা অতিক্রম করা ৫ মিনিটের পথ হলেও অনেক সময় এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে যায়। একই অবস্থা লাকসাম জংশন, চাঁদপুর রেলগেইট ও বাইপাস এলাকাতেও। ৫ থেকে ১০ মিনিটের পথ অতিক্রম করতে লেগে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা।

লালমাই উপজেলার বাগমারা বাজারে প্রায় নিত্যদিন চলাচলকারী আলমগীর হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, কুমিলস্না-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কটি দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের চালক ও যাত্রীদের বিষফোঁড়া এখন এই বাগমারা বাজার। এখানে সাপ্তাহে দুইদিন হাট বসে এবং সড়কের উপরেই বসে হাট। হাটের দিন ছাড়াও এ বাজারে নিত্যদিনই হাটবারের মতো ব্যবসা বাণিজ্য চলে। অন্যদিকে সড়কের উপর দুই পাশে সারি সারিভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সিএনজি, মিশুকসহ ছোট ছোট কিছু যানবাহন। ফলে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাগমারা বাজারে যানজট লেগেই থাকে।

লাকসাম বাইপাস এলাকার বাসিন্দা কাজী মাসউদ আলম বলেন, লাকসাম বাইপাস এলাকায় আসলে মনে হয় এটি ঢাকার মহাখালি, কাঁচপুর বা কুমিলস্নার চান্দিনা ও দাউদকান্দির মহাযানজট। দুই লেনের এই সড়কটি অতিক্রম করতে এখন এক ঘন্টারও বেশি সময় লাগে।

স্থানীয়দের ভাষ্য, গত বছরের ১২ অক্টোবর এ এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি যানজটের এ সমস্যা দ্রম্নত সমাধানের জন্য সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগকে নির্দেশ দিলেও সওজ বিভাগ এখনো দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি ও সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা নিতে পারেননি।

কুমিলস্না সওজ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কুমিলস্না নগরীর টমছমব্রিজ থেকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ পর্যন্ত ৫৯ কিলোমিটার দীর্ঘ কুমিলস্না-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ শুরু হয়। ঢাকার সঙ্গে কুমিলস্না হয়ে নোয়াখালী, লক্ষ্ণীপুর, চাঁদপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের অন্য এলাকাগুলোতে জনসাধারণের যাতায়াত সহজকরণ, যানজটের ভোগান্তি দূর, যাতায়াতে সময় কমিয়ে আনা এবং পরিবহন খরচ কমানোর জন্য ২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে আঞ্চলিক এ মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০২০ সালের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কয়েক দফা সময় বৃদ্ধি করা হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর পর প্রকল্পটির কাজ শেষ করে সওজ। তবে ৫৯ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়কটির ৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার অংশের কাজ বাকি রেখেই প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ কুমিলস্নার উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আদনান ইবনে হাসান যায়যায়দিনকে বলেন- ভূমি অধিগ্রহণ ও নানা জটিলতার কারণে ওই সময় কুমিলস্না-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের কিছু অংশের কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। ওইসব জটিলতা নিরসন করে এবং নতুন করে ভূমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে পূণঃরায় প্রক্রিয়া শুরুর চেষ্টা চলছে। নতুন আরেকটি প্রকল্পের মাধ্যমে বাকি অংশে চার লেনের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে