শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এক ভারপ্রাপ্ত প্রক্টরেই বিতর্কিত কুবি প্রশাসন

ইকবাল মুনাওয়ার, কুবি
  ১৯ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

কুমিলস্না বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকীর একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না কুবি প্রশাসনের।

জানা গেছে, ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে আইন অমান্য করে প্রক্টর হওয়া, ছাত্রলীগের সংঘর্ষে নির্লিপ্ততা, উপাচার্যের কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তার, সম্প্রসারিত প্রকল্পে ভূমি বাণিজ্য, অছাত্রদের ক্যাম্পাসে প্রবেশে সহায়তা করা ও খুনের আসামিকে নতুনভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ধ্যাকালীন কোর্সে ভর্তির সুযোগসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এরপরেও ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর পদে বহাল তবিয়তে আছেন ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের ওই সহকারী অধ্যাপক।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে তিনি মূলত উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর এ এফ এম আব্দুল মঈনের প্রশাসনকে বিপদগামী করছেন। এমনকি নিয়োগের পর থেকেই তিনি প্রতিটি উপাচার্যের শুরুর দিকে উপাচার্য থেকে বিভিন্ন পদে ভাগিয়ে নিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করেন এবং শেষ সময়ে এসে তার বিরুদ্ধাচারণ করেন। তবে ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকীর দাবি, তিনি কোনো অন্যায় কাজ করেননি।

কুমিলস্না বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৩৬(২) ধারার ১৫ এর ১-এ বলা হয়েছে, ভাইস চ্যান্সেলরের সুপারিশক্রমে, শিক্ষা প্রশাসনে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নূ্যনতম সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষকদের মধ্য থেকে সিন্ডিকেট কর্তৃক দুই বছরের জন্য একজন প্রক্টর নিযুক্ত হবেন।

তবে গত বছরের ২২ মার্চ কাজী ওমর সিদ্দিকীর ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর হিসেবে

নিয়োগের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭২ জন সহযোগী অধ্যাপক এবং ২০ জন অধ্যাপক কর্মরত ছিলেন। সহকারী অধ্যাপক হয়েও তিনি প্রক্টরের পদ ভাগিয়ে নেন। এতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা।

প্রক্টর হওয়ার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন হামলায় ইন্ধন দেওয়ার। ২০২২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনায় ৩০ থেকে ৩৫ জন নেতাকর্মী গুরুতর আহত হন। প্রক্টরিয়াল বডি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় দুই দিন ধরে চলতে থাকে এ সংঘর্ষ। শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, প্রক্টর সেখানে উপস্থিত থেকেও প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ নেননি। উল্টো পেছন থেকে তিনি এই সংঘর্ষকে বিভিন্নভাবে উস্কে দিয়েছেন।

গত বছরের ১ অক্টোবর শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্তির গুজব ছড়ালে শাখা ছাত্রলীগের ২০১৭ সালে বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেজা-ইলাহী সমর্থিত কয়েকজন নেতাকর্মী শতাধিক বহিরাগত নিয়ে প্রবেশ করে ফাঁকা গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটনায়। এদের মধ্যে স্থানীয় দোকানদার, সিএনজি চালকসহ অছাত্র ও হত্যা মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া আসামিও ছিলেন। তাদের প্রবেশের সময় ক্যাম্পাস ফটকেই অবস্থান করছিলেন প্রক্টর। তার সামনে বহিরাগতরা গুলি ছুড়লেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি।

চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি অছাত্র ও হত্যা মামলার আসামি বিপস্নব চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে কয়েকজন অছাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে উঠতে গেলে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রক্টর বাগ্‌বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এক অছাত্র দাবি করেন, প্রক্টরের নির্দেশেই তারা হলে উঠার চেষ্টা করেন। বাগ্‌বিতন্ডার জের ধরে গত ৭ মার্চ এনায়েত উলস্নাহ ও সালমান চৌধুরীকে সাময়িক বহিষ্কার করে কুবি প্রশাসন।

২০১৬ সালে নিহত খালেদ সাইফুলস্নাহ হত্যা মামলার প্রধান আসামি বিপস্নব চন্দ্র দাসকে সন্ধ্যাকালীন কোর্সে ভর্তি হতে সুযোগ করে দেওয়ারও অভিযোগ ওঠে প্রক্টরের বিরুদ্ধে। হত্যা মামলায় জবানবন্দি দেওয়া আসামিকে ফের ভর্তির সুযোগ করে দিতে ওমর সিদ্দিকীর যোগসাজশেই এ সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন।

গত ৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন আল আমিনের দোকানের সামনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এনায়েত উলস্নাহ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সালমান চৌধুরী ও বিজ্ঞান অনুষদের সহ-সভাপতি সাইদুল ইসলাম রোহানকে বেধড়ক মারধর করে সেই বিপস্নব চন্দ্র দাস ও স্থানীয় যুবদল কর্মী রনি মজুমদার। ছাত্রলীগ নেতাদের দাবি, প্রক্টরের ইন্ধনেই তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। এতে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পাঁচ দফা দাবিতে ১১ দিন ধরে টানা আন্দোলন করলেও এখনো টনক নড়েনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।

ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর কাজী ওমরের বারবার বিতর্কিত কর্মকান্ডে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ৮ মার্চ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে এবং প্রক্টরের অপসারণ দাবি করেন। প্রক্টরের অপসারণের দাবিতে তারা ক্যাম্পাসে মশাল মিছিল, বই পড়ে অবস্থান কর্মসূচি, কনসার্ট ফর জাস্টিস এবং মানববন্ধনসহ শান্তিপূর্ণ নানা আন্দোলন চলমান রেখেছে।

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) ২০১৮ সালের ১১তম সভায় অনুমোদিত কুমিলস্না বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে ভূমি বাণিজ্যের সঙ্গে তিনি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ওই প্রকল্পে সীমাহীন ভূমি বাণিজ্যের বিষয়টি সামনে আসে। জমি অধিগ্রহণের বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী ভূমি অধিগ্রহণের আগে ৬১১৩ এবং ৬১১৪ নম্বর দাগে নিজের নামে জমি ক্রয় করে রাখেন। অন্য ব্যক্তির নামেও জমি কিনেছেন তিনি। ৬১১৪ নম্বর দাগে জমির দখলদার আবদুর রাজ্জাক ও আবদুছ সালাম হলেও সেখানে কাজী ওমর সিদ্দিকীর মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে। আবদুর রাজ্জাক কুমিলস্না সদর দক্ষিণ উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ারের গাড়ি চালক। অভিযোগ আছে ওমর সিদ্দিকী উপজেলা চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠদের একজন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এই পাহাড়ি অঞ্চলে জমি অধিগ্রহণের আগে গত ১০ বছরেও কোনো জমি কেনাবেচা হয়নি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণের খবরে জমি কেনাবেচার হিড়িক পড়ে। জমি অধিগ্রহণের বিভিন্ন নথিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও একাধিক ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সিনিয়র অধ্যাপক জানান, ওমর সিদ্দিকী নিজের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে প্রশাসনকে ব্যবহার করে বিভিন্ন সময়ে উপাচার্যের সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষকের একটি সিন্ডিকেট আছে যারা যেকোনো উপাচার্যের আমলে তাদের বিশেষ উপাধি দিয়ে ও তোষামোদি করে তাকে বশ করেন। একই উপাচার্যের শেষ আমলে তার বিরোধিতা করে পরবর্তী উপাচার্যের কাছে নিজেদের বঞ্চিত হিসেবে উপস্থাপন করে সহানুভূতি নিয়ে আবারও পদ-পদবি ভাগিয়ে নেন। ফলে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও তারা বরাবরই প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন। এই অদৃশ্য শিক্ষক সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য কাজী ওমর সিদ্দিকী।

বিগত উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর এমরান কবির চৌধুরীর মেয়াদের শুরুর দিকে ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল ওমর সিদ্দিকী কাজী নজরুল ইসলাম হলের প্রাধ্যক্ষ পদ নেন। তার আমলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ কমিটির সদস্য হন তিনি। তবে তার মেয়াদের শেষদিকে বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে এমরান কবিরের বিরোধিতা করেন কাজী ওমর সিদ্দিকীসহ শিক্ষকদের একটি অংশ।

এসব বিষয়ে কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, 'আমি আমার টাকা দিয়ে জায়গা কিনেছি, আমি তো কিনতেই পারি। মারামারির ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সে তদন্ত কমিটি ব্যবস্থা নেবে। সাম্প্রতিক মারামারির বিষয়ে আমরা পুলিশ প্রশাসনকে বলেছি, তারা ব্যবস্থা নেবে।'

এসব বিষয়ে কথা বলতে উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর এ এফ এম আবদুল মঈনের সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

\হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে