মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

কারওয়ান বাজারের বস্তিতে অগ্নিকান্ডে মা-ছেলের মৃতু্য

দগ্ধ আরও দু'জন জীবন-মৃতু্যর সন্ধিক্ষণে আগুনে পুড়ে গেছে তিনশ' ঘর ফায়ার সার্ভিসের ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি
যাযাদি রিপোর্ট
  ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
রাজধানীর কারওয়ান বাজার মোলস্নাবাড়ি বস্তিতে শুক্রবার রাতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে প্রায় তিনশ' বস্তিঘর পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ছবিটি শনিবার তোলা -নাজমুল ইসলাম

রাজধানীর কারওয়ান বাজার মোলস্নাবাড়ি বস্তিতে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে মা-ছেলে এক প্রকার কয়লা হয়ে গেছে। একই ঘটনায় দগ্ধ চার বছরের পুত্রসহ আরেক মা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড পস্নাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আগুনে অন্তত তিনশ' বস্তিঘর পুড়ে গেছে।

ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার জানান, শুক্রবার রাত ২টা ২৮ মিনিটে তারা আগুন লাগার খবর পান। ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিটের চেষ্টায় ভোর ৫টা ৫০ মিনিটে আগুন নির্বাপণ করা সম্ভব হয়। অগ্নিকান্ডের সময় এক শিশুপুত্রসহ তার মাকে দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। পরে তাদের ভর্তি করা হয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড পস্নাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। আগুন নেভানোর পর ড্যাম্পিং করার সময় দুইজনের পুড়ে যাওয়া লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আগুনে পুড়ে লাশ দুটি এক প্রকার কয়লা হয়ে গেছে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বস্তির অধিকাংশ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে বৈদু্যতিক শর্ট সার্কিট বা গ্যাসের লাইন থেকে। বস্তিবাসীর অনেকেই বলছেন শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগেছে। আবার অনেকেই বলছেন গ্যাসের লাইন থেকে আগুন লেগেছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এজন্য গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ করছে।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) দুলাল হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, শনিবার সন্ধ্যায় নিহত শিশুটির পরিচয় জানা গেছে। দুই বছর বয়সি শিশুটির নাম নাফি ইসলাম। আগুনে নাফির সঙ্গে তার মাও মারা যান। মায়ের নাম শারমিন বেগম (২২)। বাড়ি জামালপুর জেলার মেলান্দহ থানাধীন শুভনচরে। শারমিনের স্বামীর নাম মিজান মিয়া। সন্ধ্যায় নিহতদের লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, নিহত শারমিনের মা ওই বস্তিতে থাকেন। দুই বছর বয়সি শিশু পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে মাকে দেখতে এসেছিলেন শারমিন। গত বছরের ৫ ডিসেম্বর শারমিন বেগম জামালপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছিলেন। নির্বাচন আর যানবাহনে নাশকতার ঘটনায় আতঙ্কে তিনি আর যাননি। দুর্ভাগ্যবশত তাকে ছেলেসহ লাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হলো।

এদিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড পস্নাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটেড আবাসিক চিকিৎসক তরিকুল ইসলাম জানান, ঘটনাস্থল থেকে দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার হওয়া মা নাজমা বেগম (২৫) ও তার চার বছর বয়সি ছেলে নজরুল ইসলামকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাদের অবস্থা আশঙ্কামুক্ত নয়। মায়ের শরীরের ২৪ ভাগ দগ্ধ হয়েছে। তার ছেলে ধোঁয়ায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার থানাধীন দাসপাড়ার ফকির বাড়ি গ্রামে। নাজমার স্বামীর নাম ওমর ফারুক।

ঘটনার পর পরই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীদের মধ্যে শুকনো খাবার ও কম্বলের ব্যবস্থা করা হয়। শনিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'এটি নিছক অগ্নিকান্ড নাকি নাশকতা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।'

দুপুর ৩টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। তার ঘটনাস্থলে আসার আগেই ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে ডিএনসিসি। পরে মেয়র আতিক সাংবাদিকদের বলেন, অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে তালিকা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারকে নগদ ৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হবে। তবে কোনো পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি বা ক্ষতির পরিমাণ বেশি হলে ওইসব পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। সেইসঙ্গে শীত থেকে আপাতত কিছুটা হলেও রক্ষা পেতে ক্ষতিগ্রস্তদের কম্বল দেয়ার নির্দেশনা দেন তিনি।

সরেজমিন দেখা গেছে, কারওয়ান বাজার রেললাইনের পূর্ব দিকে এফডিসির পেছনে আর তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালের দক্ষিণ দিকে বস্তিটির অবস্থান। এটি কারওয়ান বাজার মোলস্নাবাড়ি বস্তি নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিত।

বস্তিটির বাসিন্দা তানজিনা বেগম বলেন, 'আমি স্বামীসহ ২ বছর ধরে বস্তিটির একটি রুম মাসিক সাড়ে ৫ হাজার টাকা ভাড়ায় বসবাস করছি। স্বামী কারওয়ান বাজার মাছের আড়তে কাজ করেন। আমি বাসা বাড়িতে কাজ করি। আমাদের বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানাধীন পীতঘর ইউনিয়নের ভদ্র গ্রামে।'

অগ্নিকান্ডের বিষয়ে তিনি বলেন, 'রাত আনুমানিক তখন ২টা বাজে। প্রচন্ড

শীতে বস্তিবাসী যখন গভীর ঘুমে তখনই অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ঘটে। আগুন আগুন চিৎকারে আমাদের ঘুম ভাঙে। ওঠে দেখি বস্তির অধিকাংশ ঘরে আগুন লেগে গেছে। আগুনটি লেগেছে বস্তির মাঝ বরাবর। যেখান থেকে আগুন লেগেছিল, সেই ঘরেই দুই জন মারা গেছে। শুনেছি তারা সম্পর্কে মা ছেলে। নিহত মা ও ছেলে বস্তিতে বেড়াতে এসেছিল। ওই মায়ের মা অর্থাৎ শিশুটির নানী ওই বস্তিতে বসবাস করেন। তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তাদের শনিবার বাড়ি চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্য বলে কথা। কথায় আছে না! যার যেখানে মৃতু্য আছে, সে সেখানে নৌকা ভাড়া করে যাবে। তাই হয়েছে। পুড়ে একেবারে কয়লা হয়ে গেছে মা আর ছেলে। চেনার কোনো উপায় নেই।'

তানজিনা বলছিলেন, 'আমরা কোনোমতে জীবন আর মোবাইল নিয়ে বের হতে পেরেছি। কিছুই ঘর থেকে বের করতে পারিনি। শুধু আমরা নই, কেউ কিছুই বের করতে পারেনি। কারণ বস্তিটি থেকে শুধু মানুষ বের হওয়ার কিছু কিছু ছোট ছোট পকেট গেট আছে। মালামাল বের করার মতো বড় কোনো গেট নেই। বস্তি থেকে কোনো জিনিস বের করতে হলে উত্তর দিকের ট্রাকস্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে বের করতে হয়। আগুন লাগার পর সেই দিকে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। তাই বস্তির বাসিন্দারা শুধু জীবনটা নিয়ে পকেট গেট দিয়ে হুড়োহুড়ি করে বের হয়েছে।'

সরেজমিন আরও দেখা গেছে, বস্তির পাশ দিয়ে সড়ক বিভাগের উন্নয়ন কাজ চলছে। এজন্য বস্তিটির অধিকাংশ এলাকা স্টিলের পেস্নইন শিট দিয়ে ঘেরা। এছাড়া খুব কাছ দিয়ে যাওয়া রেল লাইনের কারণেও নিরাপত্তাজনিত কারণে লোহার ভারি এঙ্গেল দিয়ে পেস্নন শিট লাগানো হয়েছে। উন্নয়ন কাজের মালামাল এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। মালামালের চুরি ঠেকাতে এমন নিরাপত্তা নেয়া হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।

বস্তিটির বাসিন্দা রহমত আলীর ভাষ্য, বস্তিটি সরকারি জায়গায় গড়ে উঠেছে। বস্তিতে ঘরের সংখ্যা অন্তত ৫শ'। আগুনে অন্তত ৩শ' বস্তি ঘর পুড়ে গেছে। কেউ কিছুই বের করতে পারেনি। বের করার মতো কোনো সুযোগও ছিল না। কোনো মতে জীবন নিয়ে বের হতে পেরেছে। পকেট গেটগুলো না থাকলে শত শত মানুষের মৃতু্য হতে পারত।

সরেজমিন দেখা গেছে, অগ্নিকান্ডের পর খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিয়েছেন অন্তত এক হাজার বস্তিবাসী। সব হারিয়ে বস্তিবাসীরা টিনের চাল ভাঙারির দোকানগুলোর কাছে বিক্রি করছেন। সেই টাকায় খাবার কিনে খাচ্ছেন। কারণ ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারেননি। অধিকাংশ বস্তিবাসীর টাকা পুড়ে গেছে। কারণ তারা টাকা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে ঘুমায়। টাকা বের করার মতো সময়ও পাননি তারা।

ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি: ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে সভাপতি করে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শনিবার বিকালে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিনের নির্দেশে এই কমিটি গঠিত হয়। কমিটিকে আগামী ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিনকে। কমিটির অপর সদস্যরা হচ্ছেন, সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ারুল হক, মো. তানহারুল ইসলাম (উপসহকারী পরিচালক, জোন-১) ও মো. নাজিম উদ্দিন (সিনিয়র স্টেশন অফিসার, তেজগাঁও ফায়ার স্টেশন)।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে