শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

কেরানীগঞ্জে বাড়ছে খুন, অস্থিরতা!

মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
  ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
কেরানীগঞ্জে বাড়ছে খুন, অস্থিরতা!

ঢাকার উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জে কারণে-অকারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে খুন-হত্যা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। ফলে কোনোভাবেই থামছে না খুনের ঘটনা। সচেতন মহল বলছেন, আধিপত্য বিস্তারের জেরে এসব হত্যাকান্ড সংঘটিত হচ্ছে। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, কেরানীগঞ্জে বেশকিছু গ্রম্নপ মাদক কারবার, চাঁদাবাজি ও অপহরণসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এসবের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘটিত হচ্ছে বিভিন্ন অপরাধ।

সর্বশেষ যুবক মোহাম্মদ রাসেল (৩২) হত্যাকান্ডে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক। গত বুধবার (১০ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় একটি ভিডিওতে দেখা যায়, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আফতাব উদ্দিনকে আহত অবস্থায় রাসেল বলছিলেন, 'আব্বা, আপনি আমার আব্বা। আব্বা, আব্বা, আব্বা আপনি আমাকে বাঁচান।' এমন আকুতি করা অবস্থায়ও কয়েকজন যুবক রাসেলকে টানাহেঁচড়া করে পেছন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আরও একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রাসেল অচেতন অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছেন। এ অবস্থায়ও এক ব্যক্তি তাকে মারধর ও গালিগালাজ করছে। আরও একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মেঝেতে রাসেলের নিথর দেহ পড়ে আছে। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে নীলফুলা

জখম ও নির্যাতনের চিহ্ন। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। তখন কেউ একজন নাকের রক্ত মুছে দিচ্ছেন। এমনই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে কেরানীগঞ্জ উপজেলাসহ সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার অভিযোগ ও একাধিক সূত্রে জানা যায়, ৯ জানুয়ারি রাতে উপজেলার চর কালিগঞ্জ ও তেলঘাট এলাকার বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে চাঁদাবাজির টাকার ভাগবাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের নেতা রাব্বি ও তার সহযোগীদের নির্যাতনে তিনি মারা যান।

পরে এ ঘটনায় ১০ জানুয়ারি আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আফতাব উদ্দিন রাব্বিকে প্রধান আসামি করে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা করেন ওই যুবকের বাবা তোফাজ্জল হাওলাদার। আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে আফতাব উদ্দিন ও তার নিয়ন্ত্রণাধীন 'আব্বা' বাহিনীর ১৫-২০ জন রাসেলকে হত্যা করেছে বলে তার পরিবারের অভিযোগ। রাসেল বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার ভাষানচর গ্রামের বাসিন্দা তোফাজ্জল হাওলাদারের ছেলে। তিনি তার স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের খেজুরবাগ এলাকার মোজাম্মেল মাস্টারের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। ঘটনার পর থেকে ভীতসন্ত্রস্ত রাসেলের স্ত্রী সাথী বেগম ও তার পরিবারের সদস্যরা। এ বিষয়ে সাথী আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি। নিহত রাসেলের ছোট ভাই হৃদয় হোসেন বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে রাসেলকে আফতাব উদ্দিন মুঠোফোনে কল দিয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের তেলঘাট এলাকায় পারভীন টাওয়ারে তার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে যেতে বলেন। সেখানে যাওয়ার পর রাব্বিসহ ১২-১৫ জন রাতভর তার ভাইকে পিটিয়ে নির্যাতন করেন। রাসেল ঘটনাস্থলে মারা যান।

এ ঘটনায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুব আলম বলেন, মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হচ্ছে।

এর আগে গত ১০ ডিসেম্বর রাত ১০টায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে আব্দুলস্নাহপুর মালিভিটা এলাকায় শাহিন-(৪০) নামে এক যুবককে পথে কে বা কারা গুলি ও এলোপাতাড়ি মারধর করে হত্যা করে এবং ১১ ডিসেম্বর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ছুরিকাঘাতে সাগর-(২৫) নামের এক যুবক নিহত হয়েছেন। নিহত সাগর মুন্সীগঞ্জের লৌহজং পানগাঁও এলাকার রিপন মোড়লের ছেলে। তিনি পরিবারের সঙ্গে চুনকুটিয়া চৌরাস্তা এলাকায় রবিন মিয়ার বাসায় ভাড়ায় বসবাস করতেন।

এ ঘটনার বিষয় কেরানীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাবুদ্দিন কবির জানান, আব্দুলস্নাহপুর এলাকায় এলইডি বাল্ব ব্যবসায়ী শাহীনের মৃতু্য অত্যন্ত রহস্যজনক। তার বুকে যে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে, সেটা গুলির চিহ্ন ছিল। এ ছাড়া তার ডান হাতের কয়েকটি আঙুল পোড়া এবং ডান পাশের চোখ ঝলসানো ছিল। হত্যা রহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশ কাজ করছে। এ ঘটনায় নিহতের ভায়রা ভাই নাজিরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

৯ জানুয়ারি সকাল পৌনে ৭টার দিকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতের শিকার কাওসার-(২৭) নামে এক যুবকের মৃতু্য হয়। তিনি পেশায় অটোরিকশা চালক ছিলেন। কাওসারের স্ত্রী মাকসুদা বেগম জানান, 'আমার স্বামী পেশায় অটোরিকশা চালক ছিলেন। সে অটোরিকশা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন। ভোরে হাসনাবাদের মেইন রোডে ছিনতাইকারীরা ছুরিকাঘাত করে তাকে রাস্তায় ফেলে তার অটোরিকশাটি নিয়ে পালিয়ে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে পথচারীরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে দায়িত্ব চিকিৎসক আমার স্বামীকে মৃত ঘোষণা করেন।' তিনি আরও বলেন, 'ভাই আমার স্বামীকে তো আর বাঁচানো গেল না। আমরা খুব গরিব মানুষ। এখন কোত্থেকে, কীভাবে টাকার জোগাড় করে রিকশার মালিককে দেব আর সংসার চলবো, তা বুঝে উঠতে পারছি না।'

একইদিন ৯ জানুয়ারি বিকাল ৪টার দিকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল আবাসন প্রকল্পের পানির ওয়াশার লাইনের একটি ম্যানহোল থেকে অজ্ঞাত (২৫) এক নারীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় থানার ওসি মাহবুব আলম জানান, ঝিলমিল আবাসন প্রকল্পের ৬ নম্বর সেক্টোরের একটি ম্যানহোল থেকে দুর্গন্ধ পেয়ে আশপাশের লোকজন পুলিশকে খবর দিলে পরে পুলিশ ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে ওই নারীর মৃতদেহ উদ্ধার করে এবং এটি একটি হত্যাকান্ড হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ কাজ করছে।

এ ছাড়া গত ২১ সেপ্টেম্বর বিয়ের চার মাসের মাথায় স্বামীর হাতে খুন হন ফারজানা। পরকীয়া প্রেমের সন্দেহে স্ত্রীকে হত্যা করে বসিলা ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলা দেয় স্বামী রনি। তিনিই আবার শাশুড়িকে নিয়ে থানায় গিয়ে স্ত্রী নিখোঁজ বলে জিডি করেন। পরে নিশ্চিত হয়, তার নাম ফারজানা। তদন্তের সময় স্বামীর ওপর সন্দেহ হয় পুলিশের। তাকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে রনি পুলিশকে জানায়, স্ত্রীর পরকীয়া আছে- এমন সন্দেহের জেরে বুড়িগঙ্গা বসিলা সেতু থেকে ফারজানাকে ফেলে দেওয়া হয়।

গত বছর ৩০ জুলাই রাত সাড়ে ১২টার দিকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ খেজুরবাগ স্কুল রোড এলাকায় পুলিশের সোর্স সাইফুল ইসলামকে ৫-৬ জন যুবক ধারাল অস্ত্র দিয়ে মাথা ও হাতে কুপিয়ে জখম করে এবং তার একটি চোখও উপড়ে ফেলে। এ সময় তার ডাকচিৎকারে স্থানীয়রা এসে তাকে উদ্ধার করে স্যার সলিমুলস্নাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্ব চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সাইফুল শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ থানার বাসিতপুর গ্রামের আব্দুল খালেক মিয়ার ছেলে। সে পরিবারের সঙ্গে খেজুরবাগ সাতপাখি এলাকায় আওলাদ মিয়ার বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস করতেন। ঘটনার দুই দিন পরর্ যাব সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তাররা হলো- মো. রাজন হোসেন (৩১), মো. জানে আলম (৩৬), মো. সুমন ওরফে গর্দা সুমন (২৫), মো. লিটন হোসেন (২৬), মো. দিপু (২৩), মো. সরোয়ার আকন্দ (২৬) ও মো. সজীব (২৯)।

তবে পুলিশ প্রশাসন যাই বলুক না কেনো, সচেতন মহলের দাবি, নতুন বছরের শুরুতে কেরানীগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বেশ অবনতি হয়েছে। হত্যাকান্ডের ঘটনাও বেড়েছে। যদিও রাজনৈতিক অস্থিরতা দুর্বৃত্তদের অনেকটা সুযোগ দিয়েছে। এ ছাড়া ছিনতাই, হানাহানি বাড়ছে প্রতিদিন। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সঙ্গে সঙ্গে দুর্বৃত্তদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় এই অঞ্চলের বাসিন্দারা চরম আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

\হঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলছেন, 'বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় আমরা সবসময় সতর্ক আছি। তুচ্ছ ঘটনাসহ নানা কারণে খুনের ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের দ্রম্নত আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। একেবারে অপরাধ কখনো নির্মূল করা যায় না। মাদক ও সব ধরনের অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সবসময় সর্তক অবস্থানে আছে।'

ছোটখাটো অপরাধ কিংবা মনোমালিন্য, ভুল বোঝাবুঝির বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে হত্যাকান্ড সাম্প্রতিক সময় বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে উলেস্নখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও অধ্যাপক ডক্টর মো. গোলাম আজম বলেন, 'আমরা যে বাস্তবতা লক্ষ্য করছি, সেটা হলো সমাজ, পরিবারের দেনা-পাওনাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব, ভুল বোঝাবুঝির মতো পরিস্থিতি, বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক, জমিজমা-সংক্রান্ত বিরোধ, প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরিতাসহ নানা কারণে হত্যাকান্ডের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সহিংসতার কারণেও হত্যাকান্ডের উদাহরণ অনেক রয়েছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময় কোনো ব্যক্তির প্রভাবে প্রভাবিত হয়। কোনো ঘটনায় মামলা নেওয়া হয়, আবার কোনো কোনো ঘটনা গণমাধ্যমে আসলে চাপে পরবর্তীতে মামলা নিয়ে থাকে। মামলায় অভিযুক্তদের আসামি করে এজাহারে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়েও নানা ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়। অপরাধীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংযোগ গড়ে ওঠার কারণেও অনেক সময় সংঘাত, হত্যা বাড়তে পারে। একটি সমাজ তখনই কাঙ্ক্ষিত সমাজ হয়, যখন সমাজের সর্বস্তরের অংশীদাররা তার নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান জানান, অনেক যুবক রাজনৈতিক দলে ভিড়েছেন, যারা দলের আদর্শকে ধারণ করেন না। স্বার্থের জন্য তারা রাজনীতি করেন। এ থেকে তৈরি হয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল। সে কারণে হত্যাকান্ড হতে পারে। আবার রাজনৈতিক কারণের বাইরেও হতে পারে। ব্যক্তিগত শত্রম্নতাও কারণ হতে পারে। তদন্ত করলে প্রকৃত কারণ বোঝা যাবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে