বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
সেতু ভেঙে নিহত ৯

'এই দুঃখ কোথায় রাখি'

স্বজনদের আহাজারি দুটি তদন্ত কমিটি
শিবচর মাদারীপুর ও আমতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি
  ২৪ জুন ২০২৪, ০০:০০
'এই দুঃখ কোথায় রাখি'
বরগুনার আমতলীতে সেতু ভেঙে ৯ জন নিহতের ঘটনায় স্বজনহারাদের আহাজারি -যাযাদি

বরগুনার আমতলীতে সেতু ভেঙে নিহত সাতজনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। রোববার সকালে জানাজা শেষে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার ভদ্রাসন গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়। এর আগে শনিবার রাত তিনটার দিকে মরদেহ বাড়িতে পৌঁছালে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা।

শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুলস্নাহ আল মামুন নিহতদের জানাজায় শরিক হয়ে প্রত্যেক পরিবারকে দাফন খরচ বাবদ ১০ হাজার করে টাকা দেন।

1

এদিকে, একই পরিবারের ৭ জনের মৃতু্যর শোক কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না স্বজনরা। কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে আশপাশের পরিবেশ।

জানা যায়, বরগুনার আমতলীতে বোনের মেয়ে হুমায়রা আক্তারের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বুধবার রাজধানী ঢাকা থেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে মাদারীপুরের শিবচরের ভদ্রাসনের গ্রামের বাড়িতে আসেন ব্যাংক কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ। মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গেলেও প্রাণ হারায় তার স্ত্রী শাহানাজ আক্তার মুন্নী ও দুই মেয়ে তাহিয়া ও তাসদিয়া। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা কেড়ে নেয় ব্যাংক কর্মকর্তার বোন, ভাবী, দুই ভাগ্নেসহ একই পরিবারের ৭ জনকে।

পুলিশ সূত্র জানায়, আমতলীর কাউনিয়ার মনিরুল ইসলামের মেয়ে হুমায়রার সঙ্গে একই এলাকার সেলিম ইসলামের ছেলে সোহাগের বিয়ে শুক্রবার দুপুরে সম্পন্ন হয়। শনিবার দুপুরে কনেপক্ষ আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার সময় বহনকারী মাইক্রোবাসটি লোহার সেতু ভেঙে পানিতে ডুবে যায়। এ ঘটনায় ৯ জনের মৃতু্য হয়েছে। তাদের মধ্যে ৭ জনই মাদারীপুরের শিবচরের।

নিহতরা হলেন- শিবচরের ভদ্রাসন গ্রামের আবুল কালাম আজাদের স্ত্রী শাহানাজ আক্তার মুন্নী (৪০) ও তার দুই মেয়ে তাহিয়া (৭) এবং তাসদিয়া (১১)। একই এলাকার মৃত ফকরুল আহম্মেদের স্ত্রী ফরিদা বেগম (৪০), সোহেল খানের স্ত্রী রাইতি আক্তার (৩০), বাবুল মাদবরের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৪০) এবং রফিকুল ইসলামের স্ত্রী রুমি বেগম (৪০)।

নিহত ফাতেমা বেগমের স্বামী বাবুল মাতুব্বর আহাজারি করতে করতে বলেন, 'আমার সব শ্যাষ হয়ে গেল। বিয়ের আনন্দ করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরছে, এই দুঃখ কোথায় রাখি। আমি কীভাবে এই দৃশ্য ভুলব! আলস্নাহ তুমি আমাকেও ওদের সঙ্গে নিয়া যাও। ওদের ছাড়া আমিও আর বাঁচতে চাই না।'

তিনি আরও বলেন, আমরা দোষীদের শাস্তি চাই। শুনছি এলজিইডি থেকে তিন বছর আগে ব্রিজটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এরপরেও কেন যান চলাচলের অনুমতি দেওয়া হলো। যদি বন্ধ থাকতো তাহলে আমাদের এমন সর্বনাশ হতো না।

নিহত ফরিদা বেগমের ছেলে মাহাবুব খান বলেন, 'আমার মা এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে না। আমার মাকে তোমরা ফিরাইয়া দাও। যার মা নাই, তার এ দুনিয়াতে আপন বলে কেউ নাই।'

উপজেলার ভদ্রাসন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম বেপারী বলেন, একটি পরিাবরের ৭ জনের একসঙ্গে মারা যাওয়ার ঘটনায় পুরো ইউনিয়নজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। নিহতদের পরিবারকে সান্ত্বনা দেয়ারও ভাষা নেই। কীভাবে এই শোক মেনে নেবে, সেটাই বুঝতে পারছি না। তবুও এলাকাবাসী ও ইউনিয়ন পরিষদ সবসময় এই পরিবারটি পাশে থাকবে, সেই প্রত্যাশা করছি।

শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুলাহ আল মামুন বলেন, বরগুনায় সেতু ভেঙে মাইক্রোবাস খালে পড়ে ৯ জন মারা যাওয়াদের মধ্যে ৭ জনই শিবচরের। এটি খুবই দুঃখজনক। নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। ওই পরিবারের পাশে থাকবে উপজেলা প্রশাসন।

দুটি তদন্ত কমিটি গঠন

এদিকে, আমতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি জানান, সেতু ভেঙ্গে ৯ জন নিহতের ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম শনিবার রাতে ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অনিমেশ বিশ্বাসকে প্রধান এবং আমতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ আশরাফুল আলমকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- সহকারী পুলিশ সুপার আমতলী সার্কেল রুহুল আমিন, এলজিইডির বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান খাঁন, বিআরটিএ সহকারী পরিচালক মাহফুজ আহমেদ, ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স উপ-সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম। সাত কার্যদিবসের মধ্যে অনুসন্ধানপূর্বক তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অপর দিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তর তিন সদস্য তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। পটুয়াখালী তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মহির উদ্দিন শেখকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- নির্বাহী প্রকৌশলী এসি অফিস বরিশাল নুরুস সাম ও এলজিইডি বরগুনা সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান। রোববার তদন্ত কমিটি তাদের তদন্ত কাজ শুরু করেছেন। এদিকে শনিবার গভীর রাতে আমতলী থানা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা চেইন কপ্পা দিয়ে নদীতে ডুবে যাওয়া মাইক্রোবাসটি উদ্ধার করেছে।

আমতলী থানার ওসি কাজী সাখাওয়াত হোসেন তপু বলেন, চেইন কপ্পা দিয়ে মাইক্রোবাসটি উদ্ধার করা হয়েছে। ওই মাইক্রোবাসের মধ্যে আর কোনো মরদেহ পাওয়া যায়নি।

বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম বলেন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত কার্যদিবসের মধ্যে তাদের অনুসন্ধানপূর্বক প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে