বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ভারতের হামলা যেভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি বাড়িয়ে দিল

আল জাজিরার বিশ্লেষণ
  ২১ মে ২০২৫, ০৯:২৬
ভারতের হামলা যেভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি বাড়িয়ে দিল
রাওয়ালপিন্ডির একটি রাস্তায় পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির (বাঁয়ে), নৌপ্রধান অ্যাডমিরাল নাভিদ আশরাফ (বাঁয়ে), বিমানবাহিনী প্রধান মার্শাল জহির আহমেদ বাবর সিধু (বাঁয়ে) এবং প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের (বাঁয়ে) ছবি সমন্বিত একটি বিলবোর্ড

২০২৩ সালের ৯ মে, পাকিস্তানের বড় বড় শহরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।

তারা সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালায়, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভবনগুলো ছিল মূল লক্ষ্য।

1

লাহোরে এক শীর্ষ সেনা কর্মকর্তার বাসভবনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়, রাওয়ালপিন্ডিতে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে হামলা চালানো হয়।

এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-এর সমর্থক, যারা তাদের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের গ্রেফতারের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন।

তাঁকে দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট চত্বরে গ্রেফতার করা হয়। তবে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

এই বিক্ষোভ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দীর্ঘস্থায়ী আধিপত্যের ওপর এক নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল।

দুই বছর পর, প্রশংসার ঢল

২০২৫ সালের ১১ মে, প্রায় দুই বছর পর পাকিস্তানের রাস্তায় আবারও হাজার হাজার মানুষ নামলেন — তবে এবার আনন্দ-উল্লাস আর সেনাবাহিনীর প্রশংসায়।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ঘটে যাওয়া সর্বশেষ সীমান্ত সংঘাতের পর পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রতি সমর্থন এবং আস্থার জোয়ার দেখা গেছে।

গালআপ পাকিস্তানের জরিপে দেখা গেছে, ১১ থেকে ১৫ মে পরিচালিত এক সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৫০০ জনের ৯৬ শতাংশ বিশ্বাস করেন পাকিস্তান এই সংঘাতে বিজয়ী হয়েছে।

৮২ শতাংশ সেনাবাহিনীর পারফরম্যান্সকে “খুব ভালো” হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন এবং মাত্র ১ শতাংশ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ৯২ শতাংশ বলেছেন এই সংঘাতের ফলে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সেনাবাহিনীর প্রতি আরও ইতিবাচক হয়েছে।

‘কালো দিন’ থেকে ‘ন্যায়পরায়ণ যুদ্ধের দিন’

২০২৫ সালের ১০ মে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়ার এক দিন পর পাকিস্তানের শহরগুলোতে মানুষ পতাকা হাতে, গাড়ির হর্ণ বাজিয়ে, দেশাত্মবোধক গান বাজিয়ে সেনাবাহিনীর জয় উদযাপন করেন।

এই দিনটিকে সরকার ‘ন্যায়পরায়ণ যুদ্ধের দিন’ঘোষণা করে — যা ২০২৩ সালের ৯ মে-র ‘কালো দিন’-এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।

সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনিরকে ঘিরে প্রচুর প্রশংসা ও পোস্টার দেখা গেছে।

সংঘাত ও জাতীয় ঐক্য

ভারতীয় কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনার জন্য ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে।

এরপর ৭ মে ভারত পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ও পাঞ্জাবে হামলা চালায়, যাতে ৫১ জন নিহত হয়। যার মধ্যে ১১ জন ছিলেন সেনা সদস্য ও কিছু শিশু।

পরবর্তী তিন দিনে উভয় দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও গোলাবর্ষণ চালায়। দক্ষিণ এশিয়ার ১৬০ কোটিরও বেশি মানুষ যুদ্ধের আশঙ্কায় আতঙ্কিত ছিল।

যুদ্ধবিরতির পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ একে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ‘গৌরবময় অধ্যায়’ হিসেবে অভিহিত করেন।

আগস্ট ২০২৩ থেকে কারাবন্দী পিটিআই নেতা ইমরান খানও এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনীর প্রতি সমর্থন জানান।

অতীত ও বর্তমান

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানের ইতিহাসে সেনাবাহিনীর শক্তি মূলত ভারতের সঙ্গে শত্রুতার বোধ থেকেই গড়ে উঠেছে।

লন্ডনভিত্তিক গবেষক মারিয়া রশিদ বলেন, সেনাবাহিনী নিজেদের শুধু সীমান্ত রক্ষাকারী নয়, বরং জাতীয় আদর্শ রক্ষার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করে।

তবে ইমরান খানের সঙ্গে সংঘর্ষের পর সামাজিক মাধ্যমে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে।

ভবিষ্যৎ কী?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধকালীন আবেগে জনগণ সেনাবাহিনীকে সমর্থন করলেও এই সমর্থন দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে।

নিউ ইয়র্কের আলবেনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক নিলুফার সিদ্দিকি বলেন, এটি অনেকটাই নির্ভর করবে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থান এবং পিটিআই ভবিষ্যতে কীভাবে সেনাবাহিনীকে মূল্যায়ন করবে তার ওপর।

লাহোরভিত্তিক বিশ্লেষক বদর আলম বলেন, “সেনাবাহিনীর জন্য এটি শিক্ষণীয় মুহূর্ত। তারা বুঝতে পারছে, জনগণের সমর্থন ছাড়া বিজয় সম্ভব নয়।

আমাদের অর্থনীতিও ঠিক করতে হবে, নাহলে সেটিই হয়ে উঠবে সবচেয়ে বড় হুমকি।”

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে