বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা শেষ হলে তিনি দেশে ফিরবেন, এমনটি জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অনেক মিথ্যা-প্রতিহিংসামূলক মামলা রয়েছে। সেগুলো প্রত্যাহার হলে বা আদালতের মাধ্যমে শেষ হলে তিনি ফিরবেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে লন্ডন থেকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছানোর পর গণমাধ্যমে তিনি এসব কথা বলেন।
এদিকে, রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্র্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করার চেষ্টা করছে বলে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম যে বক্তব্যে দিয়েছেন, তা 'রাজনীতিবিরোধী' বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মির্জা ফখরুল বলেন, 'আমি জানি না, আসলে উনি কী উদ্দেশে, কেন এটা বলেছেন। কিন্তু ওনার এই বক্তব্য রাজনীতিবিরোধী বক্তব্য এবং আমি আশা করি না যে, তারা এ ধরনের বক্তব্য রাখবেন। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো সব সময়ই এই অন্তর্র্বর্তী সরকারকে সমর্থন করেছে এবং এই সমর্থনের একটা উদ্দেশ্য আছে, সেটা হচ্ছে গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। সেটার জন্যই আমরা কাজ করছি ১৫ বছর ধরে। আমরা সংগ্রাম, লড়াই করেছি, এটা উনি কী উদ্দেশ্য, কেন বলেছেন, আমি জানি না।'
বিএনপির লংমার্চ কর্মসূচি সামনে রেখে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে সংকট, সেটির সমাধান কীভাবে হবে, জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, 'আলোচনার মধ্য দিয়ে সংকটের সমাধান হবে। এগোচ্ছে তো।'
বিএনপি সংস্কারের চেয়ে নির্বাচনকে প্রাধান্য দিচ্ছে- এমন আলোচনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তা নাকচ করে দেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, 'এ ধরনের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আমরা দুই বছর আগে সংস্কারের কথা বলেছি, ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি। এরও আগে ২০১৬ সালে আমরা ভিশন ২০২৩ দিয়েছিলাম এবং আমরা এখনো বলছি, নূ্যনতম সংস্কারগুলো করে নির্বাচন দিতে। এ জন্য যে বাংলাদেশে সব সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে, এই সমস্যাগুলো নির্বাচিত সরকার ছাড়া সমাধান করা বেশ চ্যালেঞ্জিং।'
লন্ডন থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের (তারেক রহমান) কাছ থেকে কী বার্তা নিয়ে এসেছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির মহাসচিব বলেন, 'ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বার্তা হচ্ছে, আপনারা সবাই ধৈর্য ধরবেন। একটা বিশাল বিজয় সূচিত হয়েছে জনগণের। এই বিজয়কে ফলপ্রসূ করতে হলে অবশ্যই সবাইকে ধৈর্য ধরে কাজ করতে হবে এবং গণতন্ত্রের যেটা প্রথম পদক্ষেপ, ফটক-সেই ফটক নির্বাচনের জন্য সবাইকে প্রস্তুতি নিতে হবে।'
১ ডিসেম্বর মির্জা ফখরুল ইসলাম লন্ডন যান। এই সফরে তার স্ত্রী রাহাত আরা বেগমও সঙ্গে ছিলেন। লন্ডনে অবস্থানকালে মির্জা ফখরুল দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে কয়েক দফা একান্ত বৈঠক করেন। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় ও যুক্তরাজ্যের বাংলা গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের সঙ্গেও তিনি মতবিনিময় করেন।
এই সফর কেমন হয়েছে, জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, যে উদ্দেশে তিনি লন্ডনে গিয়েছিলেন, তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সফর ফলপ্রসূ হয়েছে।
'ভারত কী সেই প্রমত্ত ঢেউ দেখেনি'
এদিকে, ভারতকে উদ্দেশ্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম বলেছেন, তারা কী ৫ আগস্টের লাখ লাখ মানুষের প্রমত্ত ঢেউ দেখেনি? যেটি দেখে শেখ হাসিনা এমনকি ইউনিফর্মধারী বাহিনী পর্যন্ত পালিয়ে গিয়েছিল। এই দৃশ্য দেখার পর কীভাবে তারা (ভারত) কল্পনা করে, কীভাবে হিসাব করে দেশ দখল করতে কতদিন লাগবে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের আবদুস সালাম হলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত 'পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষক ভারত সরকার ও তাদের গণমাধ্যমের অবিরাম মিথ্যা প্রচারণা এবং ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ' শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
মেজর হাফিজ বলেন, এই দেশ একটি জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করে এই দেশের স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ন এবং দেশের সার্বভৌমত্বকে সঠিক ও যেকোনো কালিমামুক্ত রাখবে, এটি হলো আমাদের শপথ।
তিনি বলেন, আমাদের দেশটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। প্রত্যেকটি ইনস্টিটিউশনকে ধ্বংস করে দিয়েছেন তিনি। তিনি আজকে আবার তার সাবেক আশ্রয়স্থল ভারতে প্রবেশ করেছেন বাংলাদেশকে ধ্বংস করার জন্য, আনস্টেবল করার জন্য। আমি অবাক হয়ে যাই, পৃথিবীর বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কীভাবে তাকে আশ্রয় দিল।
মেজর হাফিজ বলেন, সমস্যা হচ্ছে ভারতের মনটা অনেক ক্ষুদ্র। প্রত্যেকটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে তারা (ভারত) বিষিয়ে তুলেছে। প্রত্যেকটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র আজ তাদের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে বড় হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে। কারণ, তারা (ভারত) দাদাগিরি করে প্রতিবেশীকে দাবিয়ে রাখতে চায়। এটা'তো একবিংশ শতাব্দীর মানুষ গ্রহণ করবে না। বাংলাদেশ'তো মোটেই না, যারা যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রে নাই। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া কল্পকাহিনী ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে যে, এখানে (বাংলাদেশে) হিন্দুদের ওপর অন্যায়-অবিচার করা হচ্ছে। এ ধরনের কল্পকাহিনী ছড়িয়ে তারা বিশ্ববাসীকে দেখাতে চায় যে, বাংলাদেশের মানুষ একপেশে, বাংলাদেশে কারও জীবন নিরাপদ নয়। আমরা সম্পূর্ণ এই মিথ্যাচারের নিন্দা জানাচ্ছি।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাতের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সাদেক খানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন- ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু প্রমুখ।
সমাবেশ শেষে তারা প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণ থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তোপখানা সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
'ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকই যথেষ্ট'
এদিকে, ভারতকে উদ্দেশ করে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, আপনি শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছেন এবং ষড়যন্ত্রে সাহায্যও করছেন। বাংলাদেশের মানুষ গরিব হতে পারে, আপনার কারণে অর্থনৈতিক দুর্বল হতে পারে। কিন্তু একবার আসেন, আমরা লাগবে না, আগরতলার কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকই যথেষ্ট আপনাকে (ভারত) প্রতিহত করতে। সে জন্য কথাবার্তা একটু ভালো করে বলা দরকার।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের অডিটোরিয়ামে জাতীয়তাবাদী নবীন দলের ১২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
ভারতকে উদ্দেশ্য করে জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, দয়া করে ভালো হয়ে যান। বাংলাদেশকে নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। ড. ইউনূস বলেই দিয়েছেন, পাশেই সেভেন সিস্টার।
বিএনপির এই নেতা বলেন, আমরা মাথা ঘামাতে চাই না। আমার দেশ একটি স্বাধীন দেশ। আমরা স্বাধীনভাবে বসবাস করতে চাই। আমি স্বাধীনভাবে নির্বাচন করতে চাই। কারও হস্তক্ষেপ কামনা করি না।
জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ভারত কী চায়? এখন'তো শেখ হাসিনা নেই। শেখ হাসিনার কিছু প্রেতাত্মা থাকলেও তার দলতো এখন শাসন করছে না। তাহলে ভয় কিসের। গতকালকে যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল ঢাকা থেকে আগরতলা অভিমুখে লংমার্চ করেছে, যে-ই আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা করেছে, জাতীয় পতাকাকে ছিঁড়ে ফেলেছে।
ভারতকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনার ওপর ভর করে এ দেশে রাজত্ব কায়েম করেছেন। বাংলাদেশে একদলীয় শাসন কায়েম করেছেন। সংবিধানকে তছনছ করে দিয়েছেন। বিচারপতির এজলাসে লাথি মেরেছেন। আয়নাঘর তৈরি করেছেন। সেই দিন এখন আর আপনাদের নেই। ষড়যন্ত্র আপনারা যতই করেন, এই ষড়যন্ত্রে কোনো লাভ হবে না। তারেক রহমান বাংলাদেশে আসবেন। এক মাথা এক ভোটে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন।
জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, আপনারা চেয়েছিলেন- শেখ হাসিনার মাথায় হাত রেখে বাংলাদেশে সেভেন সিস্টারের মতো এইট সিস্টার বানাবেন। কল্পনা করেই গেছেন, কিন্তু লাভ হয়নি। শেখ হাসিনা আশ্রয় নিয়েছে আপনার কাছে। যদি সত্যিই আপনারা গণতান্ত্রিক দেশ হন, যদি বিশ্বের বৃহত্তম দেশ হয়ে থাকেন, আপনার উচিত ছিল, শেখ হাসিনাকে আশ্রয়ের পর যখন তার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তাকে এক মিনিটের জন্য না রেখে ড. ইউনূস সরকারের কাছে হস্তান্তর করা। তাহলে আমরা বিশ্বাস করতাম, আপনি বাংলাদেশের মানুষকে সম্মান করেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, মমতাকে মনে করেছি তিনি খাঁটি গণতান্ত্রিক। কিন্তু তার কথাবার্তা এবং আচরণে আমার মনে হচ্ছে তিনি শেখ হাসিনার পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করছেন। আপনিও দিলিস্নর দ্বারা নিষ্পেষিত। দয়া করে আপনি আমাদের নিষ্পেষিত করার ষড়যন্ত্রে হাত রাখবেন না।
নবীন দলের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি হুমায়ুন আহমেদ তালুকদারের সভাপতিত্বে এবং দলটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সোহেল রানার সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তৃতা করেন- বিএনপির স্বেচ্ছাসেবক-বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সফু প্রমুখ।