বায়ুদূষণে রাজধানী ঢাকা বিশ্বের মধ্যে শীর্ষ স্থানে আছে। দূষণে ঢাকার বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। এই বাতাসে বুকভরে শ্বাস নেওয়াই কঠিন। শ্বাসের সঙ্গে যেসব দূষিত বায়ু দেহে প্রবেশ করে, তা মানুষকে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলছে। অথচ বায়ুদূষণের বিষয়টি ১ নম্বর সমস্যা হিসেবে শনাক্ত করছে না সরকার। মানুষ ঢাকায় বুকভরে শ্বাস নিতে চায়। এ জন্য সরকারের দিক থেকে দৃশ্যমান ও কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চায় জনগণ।
শুক্রবার বেলা ১১টায় রাজধানীর জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে অনতিবিলম্বে জরুরি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের দাবিতে এক অবস্থান কর্মসূচিতে এ কথা বলেন পরিবেশকর্মী ও অধিকারকর্মীরা। কর্মসূচির আয়োজক জনভাষ্য ও ই-আরকি। কর্মসূচিতে বক্তারা বলেন, ঢাকাকে বায়ুদূষণমুক্ত করতে সরকারকে এখনই কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু বিষয়টি আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে না।
এ কর্মসূচি যখন চলছিল, তখনো সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের বাতাসের মান সূচকে ঢাকার অবস্থান ছিল শীর্ষ। স্কোর ছিল ২২৫। বায়ুর এই মানকে 'খুব অস্বাস্থ্যকর' হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কর্মসূচিতে ই-আরকির প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক সিমু নাসের বলেন, যে কোনো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রধান কাজ হলো সমস্যাকে আগে স্বীকার করা। বায়ুদূষণ যে ১ নম্বর সমস্যা, তা সরকার ভাবেই না। বায়ুদূষণ কমাতে সরকারের কোনো পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ দেখা যায় না। কারণ তারা তো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে (এসি) থাকে। শীতকালে দূষণের কারণে ঢাকার বাতাস ভারী হয়ে লোকজন নানান ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
ঢাকায় সবাই বুকভরে শ্বাস নিতে চায়, সুন্দরভাবে বাঁচতে চায় বলে মন্তব্য করেন অভিনেতা সুমন আনোয়ার। তিনি বলেন, অথচ পরিকল্পনাহীনভাবে কাজ চলায় ঢাকা বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ বায়ুদূষণের স্থানে পরিণত হয়েছে। কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ঢাকা বড় হচ্ছে। ঢাকাকে কেন্দ্র করে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় যারা রয়েছেন, তারা ঠিকই তাদের কার্যালয়, বাসা ও গাড়িতে এসি স্থাপন করে দূষণমুক্ত রাখছেন। দুর্ভোগে রয়েছে সাধারণ মানুষ।
কর্মসূচিতে 'বাসযোগ্য ঢাকা চাই', 'বায়ুদূষণকারী প্রকল্প নয়', 'পরিবেশবান্ধব গণপরিবহন চাই', 'ঢাকা অবাসযোগ্য গ্যাস চেম্বার', 'ধোঁয়ার বদলে সবুজ চাই', 'নির্মল বায়ু আইন পাস করো', 'আমাদের শ্বাস নিতে দাও', 'নির্মাণকাজে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করো', 'পরিষ্কার বাতাস ও সুস্থ জীবন চাই' লেখা পস্ন্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ান পরিবেশকর্মী, অধিকারকর্মী ও তাদের শিশুসন্তানেরা।
কর্মসূচিতে নারী উদ্যোক্তা তাসলিমা মিজি বলেন, বায়ু ও পরিবেশদূষণের দায় প্রত্যেকের। রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতা রয়েছে। বিগত সরকারের সময়ে পরিবেশ নিয়ে অবহেলা ও দুর্নীতি ছিল। সেই সরকারকে উৎখাত করেছে মানুষ। এখন অন্তর্র্বর্তী সরকার সংস্কার কাজ করছে। এই সময়ে তাদের উচিত আইন, নীতি ও বিধি বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের জন্য দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা। এ বিষয়ে সরকারের দৃশ্যমান কর্মসূচি দেখতে চায় জনগণ।
প্রশ্নের মাধ্যমে কাউকে জবাবদিহির মধ্যে আনার চর্চা নেই বলে মন্তব্য করেন উন্নয়নকর্মী সাবিনা পারভীন। তিনি বলেন, রাজনীতি নিয়ে যত প্রশ্ন করা হয়, তার চেয়ে ১০০ গুণ বেশি প্রশ্ন করা উচিত বায়ুদূষণ নিয়ে। যারা পরিবেশ নিয়ে কথা বলতেন, তারাও ক্ষমতায় গেলে তা ভুলে যান। বায়ুদূষণ ঠিক না করলে কোনো সংস্কারই মানুষের কাজে আসবে না।
বায়ুদূষণ পরিস্থিতি গুরুতর হলেও তা আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন কবি ও অধিকারকর্মী ফেরদৌস আরা রুমী। তিনি বলেন, কারণ এখানে রাজনীতি নেই, কাউকে ঘায়েল করার বিষয় নেই। বায়ুদূষণের কারণে নগরবাসীর প্রত্যেকে কাশি, অ্যালার্জিসহ কোনো না কোনোভাবে ভুগছে। বায়ুদূষণে বাংলাদেশ প্রতিদিন শীর্ষ স্থানে থেকে রেকর্ড করছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। কোন এলাকায় বায়ুর মান কতটা বিপজ্জনক পর্যায়ে আছে, তা নিয়ে সরকার মানুষকে খুদে বার্তার মাধ্যমে সংকেত পাঠাতে পারে। যাতে মানুষ প্রয়োজন না হলে ওই এলাকায় না যায় বা মাস্ক ব্যবহার করে।
পরিবেশকর্মী নয়ন সরকার কিছু গবেষণার তথ্য তুলে ধরেন কর্মসূচিতে। এতে বলা হয়, দূষণের বেশ কিছু উৎস রয়েছে। ঢাকার বায়ুদূষণের ৩০ শতাংশ হয় নির্মাণকাজ থেকে। ইটভাটা ও কারখানা থেকে ২৯ শতাংশ। যানবাহন থেকে ১৫ শতাংশ। এ ছাড়া আন্তদেশীয় বায়ু (প্রায় ১০ শতাংশ), রান্নার চুলা (প্রায় ৯ শতাংশ) ও বর্জ্য পোড়ানো থেকে (৮ শতাংশ) বায়ুদূষণ হচ্ছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, দূষিত বায়ুতে থাকার কারণে বছরে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৬ বছর ৮ মাস কমে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের প্রভাবে ২০১৯ সালে অন্তত ৭৮ হাজার ১৪৫ জনের মৃতু্য হয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৯ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে।
নয়ন সরকার বলেন, বায়ুদূষণ দূর করা সময়সাপেক্ষ। তবে দ্রম্নত কিছু পদক্ষেপে বায়ুর মানের উন্নতি হবে। প্রতিদিন দুই বেলা করে সড়কে পানি ছিটাতে হবে। সড়কে যেসব খোঁড়াখুঁড়ি বা নির্মাণকাজ চলছে, তা নির্মাণবিধি মেনে সাত দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। নয়তো শীতের এই দুই মাসের জন্য বন্ধ ঘোষণা করতে হবে। বায়ুমানে অবনতি হলে নির্মাণকাজ বন্ধ করার নির্দেশনা দিতে হবে। গাবতলী, যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা দিয়ে যেসব ট্রাক বালু-ইট নিয়ে শহরে প্রবেশ করে, সেসব মালামাল ঢেকে রাখার নিয়ম কার্যকর করতে নজরদারি বাড়াতে হবে। পরিস্থিতির অবনতি হলে এসব ট্রাকের শহরে প্রবেশ সীমিত করতে হবে বা নিষিদ্ধ করতে হবে।