বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলার পর্দা নেমেছে। শুক্রবার মেলার শেষ দিনের সমাপনী অনুষ্ঠানে আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, 'আমাদের জাতীয় জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা '৫২-র ভাষা আন্দোলন। এই ঘটনাটিকে স্মরণ করেই আমরা প্রতিবছর ফেব্রম্নয়ারি মাসব্যাপী বইমেলা আয়োজন করি। আগামী দিনগুলোতে জনআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে বইমেলাকে কী করে আরও সুন্দর করা যায় সে বিষয়টি আমাদের বিবেচনা করতে হবে।'
অনুষ্ঠানে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য-সচিব তার প্রতিবেদনে জানান, বইমেলায় বাংলা একাডেমিসহ সকল প্রতিষ্ঠানের বই ২৫ শতাংশ কমিশনে বিক্রি হয়েছে। বাংলা একাডেমি ২৭ দিনে ৬১ লাখ ৬৫ হাজার ৫৯৩ টাকার বই বিক্রি করেছে। শেষ দিনে মেলায় প্রকাশিত হয়েছে ৩৩৫টি বই। এ নিয়ে মেলায় এ পর্যন্ত ৩২৯৯টি বই প্রকাশিত হয়েছে। গত বছর বই প্রকাশিত হয়েছিল ৩ হাজার ৭৫১টি। তার আগের বছর প্রকাশিত হয় ৩ হাজার ৭৩০টি বই।
বইমেলার শেষ শুক্রবারের ছুটির দিনে সকাল থেকেই অভিভাবকদের সঙ্গে আসা শিশু-কিশোরদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে মেলার শিশুচত্বর। তবে এবারের মেলায় 'সিসিমপুর' না থাকায় সমাপনী শিশুপ্রহর ছিল অনেকটা প্রাণহীন। এদিন বেলা ১১টায় খোলে বইমেলার দুয়ার। দুপুর ১টা পর্যন্ত ছিল শিশুপ্রহর। মাস পেরিয়ে আসা মেলার শেষ দিনে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টলে বিক্রয়কর্মীদের চেহারায় ছিল ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ।
মিরপুর থেকে বড় ভাইয়েল সঙ্গে এসেছিল নাফিজা তাবাসসুম। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া নাফিজা বইয়ের স্টলের সামনে সেলফি তুলছিল। এবার মেলায় 'সিসিমপুর' না থাকায় মন খারাপ হওয়ার কথা জানায় সে। নাফিজার ভাষ্যে- 'প্রতিবছরই বইমেলায় আসি, কিছু বইও কিনি। তবে এবার পছন্দের অনেক লেখক নেই মেলায়। বইয়ের সংখ্যাও কম। মেলায় সিসিমপুরও নেই। কেমন জানি, প্রাণ নেই।'
তবে এদিন দুপুরে শিশুচত্বরে স্থাপিত 'শৈশব' মঞ্চে বসে গল্পের আসর। মেলায় আসা শিশুরা এই আসরে যোগ দিয়ে গল্প বলা উপভোগ করে।
প্রকাশনা সংশ্লিষ্টরাও বলছেন একই কথা। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেক লেখকই এবার মেলায় আসেননি। পঙ্খীরাজের প্রকাশক দেওয়ান আজিজ সাংবাদিকদের বলেন, 'এবার সামগ্রিকভাবেই মেলা হতাশ করেছে। আশানুরূপ বিক্রি হয়নি।'
এবার মেলার শিশু চত্বরটি আরও রঙিন করে সাজানো হয়েছে। মন্দিরের প্রবেশ পথ দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করলেই হাতের ডান দিকে 'শিশু চত্বর' লেখা প্রবেশ পথ। মেলার ভেতরে যেতেই চোখে পড়ে শিশুদের ছোটাছুটি। এ বছর শিশু চত্বরে শিশুদের জন্য ৭৪টি প্রতিষ্ঠানকে ১২০টি ইউনিটের স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই চত্বরের বাইরেও শিশুতোষ বইয়ের কিছু প্রকাশনীর স্টল ছিল।
শুক্রবার দুপুরে বইমেলায় লোক সমাগম কম হলেও সন্ধ্যার আগে জনসমুদ্রে পরিণত হয় মেলাপ্রাঙ্গণ। অন্যদিনের তুলনায় বিক্রিও হয় বেশি। এদিন যারা মেলায় এসেছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকের হাতেই বই দেখা গেছে।
সমাপনী অনুষ্ঠানে কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার ২০২৫, সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ্ সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪, চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার এবং শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার প্রাপ্তদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।
সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ২৪-এর অভু্যত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কিছু অস্থিরতা সত্ত্বেও এ বছর আমরা 'অমর একুশে বইমেলা' আয়োজন করেছি। ভবিষ্যতে বইমেলাকে নতুন আঙ্গিকে নতুন মাত্রায় আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং বাংলা একাডেমিকে নতুন চিন্তাচেতনার ধারক একটি গতিশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সচিবের রুটিন দায়িত্ব) মো. মফিদুর রহমান বলেন, এবারের একুশে বইমেলা নতুন তাৎপর্য নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। আগামীতে
তথ্য প্রযুক্তির সম্মিলন ঘটিয়ে বইমেলাকে কীভাবে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ভাষা আন্দোলনের চেতনাবহ ফেব্রম্নয়ারি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ মাস। মাসব্যাপী আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা ভাষার জন্য জীবনদানকারী শহিদদের স্মৃতি ধরে রাখার একটি মাধ্যম।
এবার বাংলা একাডেমি ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে ৭০৮টি প্রতিষ্ঠানকে ১০৮৪ ইউনিটের স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাংলা একাডেমি-সহ ৩৭টি প্রতিষ্ঠান উভয় প্রান্তে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ পায়। এক ইউনিটের ৩৮৪টি, দুই ইউনিটের ২১৯টি, তিন ইউনিটের ৬১টি এবং চার ইউনিটের ২৩টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। শিশুদের জন্য ৭৪টি প্রতিষ্ঠানকে ১২০টি ইউনিটের স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। লিটল ম্যাগাজিন চত্বরের অবস্থান রয়েছে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছে। এই চত্বরে ১৩০টি লিটলম্যাগ স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়।