ভূপৃষ্ঠের গভীরে টেকটোনিক পেস্নটগুলো আগের তুলনায় বেশি সরছে বলে প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, ইন্ডিয়া পেস্নট পূর্ব দিকে বার্মা পেস্নটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে আর বার্মিজ পেস্নট পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে, সেখানে যে পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে তাতে আট মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হতে পারে। আর এই মাত্রার ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকাসহ দেশে ভয়াবহ বিপর্যয়ের শঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূতাত্ত্বিক গঠন অনুসারে উত্তরে তিব্বত সাব-পেস্নট, ইন্ডিয়ান পেস্নট এবং দক্ষিণে বার্মিজ সাব-পেস্নটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে আছে দেশ। ভূমিকম্পে ঢাকা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, নেত্রকোনা ও দিনাজপুর অঞ্চলই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
৫ মার্চ বুধবারও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা কেঁপে উঠে ভূমিকম্পে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মাঝারি মাত্রার এই ভূমিকম্পটির রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫.৬। যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ভারতের মণিপুরের রাজধানী ইম্ফ?লের ইয়ারিপক এলাকা। ভূমিকম্পটির গভীরতা ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার।
মাঝেমধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূকম্পনে কেঁপে উঠছে দেশ। এসব ভূমিকম্পে তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও সামনে বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সাম্প্রতিককালে একটির পর একটি স্বল্পমাত্রার ভূকম্পনের আঘাত ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। কোনো পূর্বাভাসের ব্যবস্থা না থাকায় মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ দিনে চার দফা ছোট থেকে মাঝারি আকারের যে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, প্রায় প্রতিটিরই উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের সীমানার ভেতর বা আশপাশে।
সাম্প্রতিক এই ভূমিকম্প নিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের কর্মকর্তা মো. রুবায়েত কবীর জানান, ঢাকা থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ছিল ৪৪৯ কিলোমিটার। ভূমিকম্পে ঢাকা ছাড়াও গাজীপুর, চট্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সিলেটসহ বেশ কয়েকটি স্থানে কম্পন টের পাওয়া যায়। এ নিয়ে গত ১০ দিনে দেশে চারবার ভূমিকম্প অনুভূত হলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের কারণে এসব সিসমিক কর্মকান্ড ঘটছে- যা স্বাভাবিক হলেও তাতে জনমনে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। প্রতিটি ভূমিকম্পের পর নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সিসমিক বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এসব ভূমিকম্প দেশের ভূতাত্ত্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত। তারা আরও বলেন, ভূমিকম্পের মাত্রা কম হলেও এর পরিণতি হতে পারে বড়, তাই নাগরিকদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এবং কাছাকাছি এলাকায় ২৮টি ভূমিকম্প হয়। ২০২৩ সালে এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১টি এবং গত বছর ২০২৪ সালে দেশে ও আশপাশে ৫৩টি ভূমিকম্প হয়েছে। এটি ছিল আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এদিকে, ভারতীয় বিজ্ঞানীরা বলছেন, হিমালয় পর্বতের রাজকীয় শিখরের নিচে, ভারতীয় এবং ইউরেশিয়ান টেকটোনিক পেস্নটগুলো গত ৬ কোটি বছর ধরে ধীর গতিতে সংঘর্ষ চালিয়ে যাচ্ছে। এই ভূতাত্ত্বিক সংঘর্ষ শুধু পাহাড়ই তৈরি করেনি, বরং ভূপৃষ্ঠের গভীরে রহস্যময় প্রক্রিয়াকে আশ্রয় দিয়েছে। সংঘর্ষের সময় পৃথিবীর আবরণে সাবডাকশন (একটি ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া যেখানে টেকটোনিক পেস্নট একটি দ্বিতীয় পেস্নটের সঙ্গে একত্রিত হয়, সেখানে ভারী পেস্নটটি অন্যটির নিচে চলে যায়। একটি অঞ্চল যেখানে এই প্রক্রিয়াটি ঘটে তাকে সাবডাকশন জোন বলা হয়) প্রতিরোধ করে। ব্যতিক্রমী এই বৈশিষ্ট্য ইউরেশিয়ান পেস্নটের সঙ্গে চলতে থাকা ভারতীয় পেস্নটের আচরণ নিয়ে পারস্পরিক আলোচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে বিজ্ঞানীদের।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, তিব্বতের তলদেশে হওয়া ভূমিকম্পের তরঙ্গের নতুন বিশ্লেষণ এবং ভূপৃষ্ঠে উঠে আসা নির্দিষ্ট গ্যাসের উপস্থিতি পূর্বে যা আবিষ্কৃত হয়নি সেই সম্ভাবনার ওপর আলোকপাত করেছে। এই তত্ত্বটি বোঝাচ্ছে যে, ইউরেশিয়ান পেস্নটের নিচে গিয়ে ভারতীয় পেস্নটের একটি অংশের স্তরবিন্যাস হচ্ছে এবং ঘন নিচের অংশটি ওপরের অংশ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
গবেষকরা এখন অন্বেষণ করছেন কীভাবে পেস্নটের ছিন্নভিন্ন হওয়া এই অঞ্চলের ভূমিকম্পকে প্রভাবিত করতে পারে। ছিঁড়ে যাওয়ার কারণ হলো কোনা-সাংরি ফাটল, তিব্বত মালভূমিতে একটি বড় ফাটল। অনুসন্ধানগুলো মহাদেশীয় সংঘর্ষের বিষয়ে আমাদের জ্ঞান বাড়ায়, এটি এমন একটি প্রক্রিয়া- যা পৃথিবীর বেশিরভাগ ভূখন্ডকে আকার দিয়েছে। সাইমন ক্লেম্পেরারের মতো বিজ্ঞানীরা তাদের অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন।
২০২৩ সালের তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। আহত হন আরও হাজার হাজার মানুষ। এ ভূমিকম্পকে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পগুলোর একটি বলে মনে করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওই এলাকার মাটির নিচে থাকা অ্যারাবিয়ান পেস্নটটি উত্তর দিকে সরে গিয়ে আনাতোলিয়ান পেস্নটে ধাক্কা দিলে এই ভয়াবহ ভূমিকম্পের তৈরি হয়। একই কারণে ১৮২২ সালেও এখানেই একদফা ভূমিকম্প হয়েছিল। বিশ্বের যেসব এলাকা ভূমিকম্প প্রবণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, তুরস্কের এই এলাকাটি তার অন্যতম।
এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কয়েকটি পেস্নট থাকার কারণে এসব এলাকা ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, 'উত্তরে তিব্বত সাব-পেস্নট, ইন্ডিয়ান পেস্নট এবং দক্ষিণে বার্মা সাব-পেস্নটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। সিলেট-সুনামগঞ্জ হয়ে, কিশোরগঞ্জ ও চট্টগ্রাম হয়ে একেবারে দক্ষিণ সুমাত্রা পর্যন্ত চলে গেছে এই পেস্নট। ফলে এসব অঞ্চল ভূমিকম্পের সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে।'
তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশে অন্তত ৬৩ বার ভূমিকম্প হয়েছে। ছোট ছোট এসব ভূমিকম্প বড় ধরনের ভূমিকম্পের ইঙ্গিত উলেস্নখ করে বিশেষজ্ঞরা সিলেট অঞ্চলকে আগেই ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তারা বলছেন, সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কয়েকটি পেস্নট থাকার কারণে এসব এলাকা ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে। সুনামগঞ্জ, জাফলং অংশে ডাউকি ফল্টের পূর্ব পাশে ভূমিকম্পের ঝুঁঁকি প্রবল। এসব ফল্টে ভূমিকম্প হলে ঢাকাসহ সারাদেশে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বা বিপদের মাত্রা অনেক বেশি বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
বিজ্ঞানীদের মতে, বড় ভূমিকম্পের শত বছরের মধ্যে আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়। দেশে সবশেষ বড় ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে। এছাড়া, ১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের ইতিহাস রয়েছে। সে হিসাবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা প্রকট।
এছাড়া, ২০০ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশে ৮টি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে একটি হয়েছিল ১৮৬৯ সালে সিলেট অঞ্চলের কাছার এলাকায়। রিখটার স্কেলে এ কম্পনের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৬। ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প, ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল, ১৯২৩ সালের দুর্গাপুরের ভূমিকম্পের এ অঞ্চল ভীষণ ঝুঁকিতে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওই ভূমিকম্পের কারণে সিলেটে বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়- যা এখনো রয়েছে। 'ডাউকি ফল্টে' অবস্থান হওয়ায় সিলেট বড় ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হতে পারে বলেও তারা আশঙ্কা করছেন। ভারতের মেঘালয়ের শিলং থেকে সিলেট হয়ে ভুটান পর্যন্ত ভূগর্ভে যে চু্যতি আছে তাতে বিপুল পরিমাণে শক্তি জমা হয়েছে। সেটি মৃদু ভূমিকম্পের মাধ্যমে বেরিয়ে এসে বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা।
বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, বার্মিজ পেস্নট বছরে ২ সেমি করে এগিয়ে যাচ্ছে ইন্ডিয়ান পেস্নটের দিকে। অন্যদিকে, বছরে ৬ সেমি করে ইউরেশিয়ান পেস্নটের দিকে এগোচ্ছে ইন্ডিয়ান পেস্নট। আবার হিমালয়ের পাদদেশে নেপাল যে টেকটোনিক পেস্নটের ওপরে বসে রয়েছে সেটার ওপরেই রয়েছে ভারতের উত্তর অংশ।
হায়দরাবাদভিত্তিক ন্যাশনাল জিওফিজিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এনজিআরআই)-এর গবেষণা অনুযায়ী, পৃথিবীর উপরিতলে থাকা বিভিন্ন পেস্নট ক্রমাগত নড়াচড়া করছে। এর মধ্যে ভারতীয় পেস্নটটি ৫ সেমি করে সরে যাচ্ছে প্রতি বছর। এ কারণেই অস্বাভাবিকভাবে চাপ বাড়ছে হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চলে যা বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে বড়সড় ভূমিকম্পের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।