সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দ্রম্নত সময়ের মধ্যে 'জুলাই সনদ' প্রণয়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে ৩৪টি দল ও জোটের কাছে ১৩ মার্চের মধ্যে মতামত চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার পরের ধাপ নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। আমরা চাই- দ্রম্নত আলোচনা করতে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঐকমত্যে পৌঁছে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে।
সোমবার জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হল মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন আলী রিয়াজ।
তিনি বলেন, 'দলগুলোর কাছ থেকে তাদের মতামত প্রাপ্তি সাপেক্ষে আমরা দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করব। এজন্য এখনো পর্যন্ত আমরা কোনো সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ধারণ
করিনি। যখন যে দলের মতামত পাওয়া যাবে, সেই সময় থেকেই আলোচনা শুরু হবে।'
২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টের গণঅভু্যথানের পর মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেন। এরই মধ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং পুলিশ সংস্কারের জন্যে গঠিত ছয় কমিশন তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
এসব সুপারিশ বিবেচনা ও জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তির সঙ্গে আলোচনা করতে ঐকমত্য কমিশন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। আর ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রিয়াজ। বাকি কমিশনগুলোর প্রধানরাও ঐকমত্য কমিশনের সদস্য।
ছয় মাস মেয়াদি এ কমিশন গত ১৫ ফেব্রম্নয়ারি কাজ শুরু করে জানিয়ে সহ-সভাপতি আলী রিয়াজ বলেন, কমিশনের যাত্রার দিন প্রধান উপদেষ্টা ও কমিশন সভাপতি অধ্যাপক ইউনূসের সভাপতিত্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সৌজন্য সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ৩৪টি দলের মোট ১০৪ জন প্রতিনিধি অংশ নেন।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, সভায় অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ৩৪টি দলের কাছে ছয়টি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের অনুলিপি ২২ ফেব্রম্নয়ারির মধ্যে পৌঁছে দেওয়া হয়। ইতোপূর্বে সব দলকে প্রতিবেদনগুলোর সফট কপিও পাঠানো হয়।
এরপরে ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা তিন দফা বৈঠক করে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ চিহ্নিত করেন বলে জানান আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, 'পাঁচটি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশসমূহকে ছক আকারে বিন্যস্ত করা হয়। এসব ছকে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোকে যুক্ত করা হয়নি। পুলিশ সংস্কার কমিশন মনে করে যে, তাদের সুপারিশসমূহ প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব।'
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি জানান, মোট ১৬৬টি সুপারিশ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশ ৭০টি, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত সুপারিশ ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৬টি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত ২০টি সুপারিশ রয়েছে। ওই সুপারিশমালা ৩৪টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে ৬ মার্চ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বলে জানান আলী রিয়াজ।
তিনি বলেন, 'প্রতিটি সুপারিশের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। প্রথমটি হলো-সংশ্লিষ্ট সুপারিশের বিষয়ে একমত কি না। এতে তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো- 'একমত', 'একমত নই' এবং 'আংশিকভাবে একমত'। এ তিনটি বিকল্পের যেকোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে।'
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রিয়াজ বলেন, 'দ্বিতীয়টি হলো প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে সংস্কারের সময়কাল ও বাস্তবায়নের উপায়। এই ক্ষেত্রে ছয়টি বিকল্প আছে। সেগুলো হলো- 'নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে', 'নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে', 'নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে', 'গণপরিষদের মাধ্যমে', 'নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে' এবং 'গণপরিষদ ও আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে'। এসব ঘরের যেকোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত দিতে বলা হয়েছে। এর বাইরে প্রতিটি সুপারিশের পাশে দলগুলোকে 'মন্তব্য' দেওয়ার জন্য জায়গা রাখা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, 'আমরা আশা করছি যে, আগামী ১৩ মার্চের মধ্যে রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলো তাদের মতামত আমাদেরকে জানাবেন। ইতোমধ্যে যদি কোনও প্রশ্ন থাকে বা ব্যাখ্যার দরকার হয়, তবে কমিশন সেসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এবং এইসব বিষয়ে আলোচনা করতে সবসময় প্রস্তত আছে।'
আলী রীয়াজ জানান, গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশমালার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি নাগরিকদের মতামত জানতে চাওয়া হবে। এক্ষেত্রে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মতামত চাওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'অধ্যাদেশের মাধ্যমেও সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব, অতীতে বাংলাদেশে এটা হয়েছে।'
সংবাদ সম্মেলনে ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি বাদে বাকি সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন- জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান বিচারপতি এমদাদুল হক এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও সেখানে ছিলেন।