অনন্তপুর গ্রামের পূর্বপাড়ার ভূঁইয়াবাড়ীর নূরুল হক ভূঁইয়ার তিন ছেলে। মহসিন, শাহিন ও কামরুল। মহসিন সবার বড়। শাহিন মেঝো আর কামরুল ছোট। মহসিন গ্রামে থাকে না। ঢাকায় একটা গ্রম্নপ অব কোম্পানিতে চাকরি করে। মাসে একবার বাড়ি আসে। শাহিন ও কামরুল কয়েক মাস আগেও বাড়িতে ছিল। তিনজনেই বিয়ে করেছে। তিন ভাইয়েরই ছেলেমেয়ে হয়েছে। সংসারে খরচ বেড়ে গেছে। তাই তিন ভাই আলাদা হয়েছে। কিছুদিন আগে নূরুল হক নিজে জমিজমা, বাড়িঘর ভাগবাঁটোয়ারা করে দিয়েছে তিন ছেলের মাঝে। আলাদা হওয়ার পরই তিন ভাই বিশেষ করে, কামরুল ও শাহিন জীবনজীবিকার নিগূঢ় তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাই জীবিকার সন্ধানে দুই ভাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। ছোটবেলায় মহসিন লেখাপড়া করে কলেজ পাস করলেও শাহিন ও কামরুল বেশি লেখাপড়া করেনি। কোনো মতে প্রাইমারি পাস করেছিল। হাইস্কুলে পড়তে গিয়ে দুই ভাই অমনোযোগী হয়ে পড়েছিল। তাই নূরুল হক দুই ছেলেকে জমিনে কৃষি কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। বাবার সঙ্গে কৃষি কাজ করে সংসারটা ভালোভাবেই সামলে নিচ্ছিল। কিন্তু দুই ভাই বিয়ে করার পর সংসারের খরচ বেড়ে গেলে দিনরাত অভাব-অনটন নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ হতো। তাই তিন ছেলেকে আলাদা করে দিয়েছে নূরুল হক। নিজের কাঁধে যখন সংসারের ভার পড়েছে তখনই দুই ভাই শৈশবে লেখাপড়া না করার জন্য আপসোস করেছে। লেখাপড়া করলে বড় ভাই মহসিনের মতো তারাও চাকরি-বাকরি করে পয়সা রোজগার করে বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখে দিন কাটাতে পারত। কিন্তু লেখাপড়া করেনি বলে চাকরি করতে পারছে না। তাই বাবার কাছ থেকে পাওয়া জমিন থেকে কয়েক শতাংশ জমি বিক্রি করে কয়েক লাখ টাকা জোগাড় করে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে চলে গেছে। বিদেশে যাওয়ার আগে দুই ভাই তাদের বউকে বলে গেছে কোনো কিছু নিয়ে ঝগড়া যেন না করে। যেন দুই জা মিলেমিশে থাকে। কিন্তু দুই জা মোটেও মিলে-মিশে থাকছে না। প্রায়ই ঝগড়া লাগে।
দুই জা একবার ঝগড়া লেগে গেলে আর থামে না। শিশুর কান্নার মতো থেমে থেমে চলতে থাকে। দুই দিন, তিন দিন, এমনকি এক সপ্তাহজুড়েও চলে। শ্বশুর কিংবা শ্বাশুড়ি এসে রান্নাঘর থেকে কাঠখড়ি নিয়ে মারার ভয় দেখালে অথবা কখনো কখনো দু'জনের পিঠে দুই ঘা পড়লে তবে ক্ষ্যান্ত হয়। দু'জনের ঝগড়া বেশিরভাগ শুরু হয় অতি তুচ্ছ কোনো ব্যাপার নিয়ে। এই যেমন কিছুদিন আগের ঝগড়ার ব্যাপারটা খেয়াল করেন। একেবারে সাধারণ একটা ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়েছিল। চলছিল দিন ভর। থামার কোনো লক্ষণই ছিল না। শেষমেশ সন্ধ্যার একটু আগে থেমেছিল, তাও কারও হস্তক্ষেপে নয়। তাদের ঝগড়া থামিয়েছিল গোয়াল ঘরের লাল গরুটা এসে! গরু কী করে ঝগড়া থামাল?
দুই জায়ের বাড়ির সীমানায় একটা বরইগাছ আছে। গাছটা কেউ রোপণ করেনি। এমনি এমনি গজিয়েছিল। দুই বাড়ির সীমানা চিহ্নিত করেছে বলে গাছটা কেউ কাটেওনি।
বরইগাছটা যেভাবে জন্মেছে একটা লাউগাছও ঠিক সেভাবে জন্মেছে। লাউগাছটা জন্মেছে বরইগাছের গোড়ায়। একদম শিকরের কাছ জন্মেছে বলে লাউ গাছটা বড় হতে হতে বরইগাছে ডাল বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। ধীরে ধীরে বরইগাছের সব ডালে জড়িয়ে পড়ল। পাতা মেলে লকলকে হয়ে উঠল। লাউও ধরল দু'একটা। বরইগাছের যে ডালটা শাহিনের বউয়ের বাড়ির সীমনায় হেলে পড়ল সেই ডালে একটা লাউ বেশ বড় হয়ে উঠল। তাই লাউটার প্রতি নজর রাখল সে। আরেকটু বড় হলেই লাউটা পেড়ে তরকারি বানিয়ে টাকিমাছ কিংবা মাগুরমাছ দিয়ে রান্না করে খাবে। লাউটা ছিল কামরুলের বউয়ের নজরেও। বাইনমাছ কিংবা শোলমাছের মাথা দিয়ে লাউটা রান্না করে খেতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে। লাউটা দিনে দিনে বাড়তে লাগল আর দুই বউ অপেক্ষা করতে লাগল। শাহিনের বউ ভাবল, বরইগাছের বেশির ভাগ ডাল আমাদের উঠোনে হেলে পড়েছে- সেই ডালে লাউটা ধরেছে। কাজেই লাউটা আমাদেরই। কামরুলের বউ ভাবল, বরইগাছটা আমাদের সীমনায়, তাই লাউটা খাওয়ার অধিকার কেবল আমারই।
দু'জনের ভাবনা চলছিল মনে মনে, সবার অগোচরে। লাউ কিংবা লাউগাছ কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কেউ কারো মনের কথা জানতে পারল না।
কয়েকদিন পর এক বিকালে শাহিনের বউ লাউটা পেড়ে নিতে এলো। সেদিনই কামরুলের বউয়ের রান্নাঘরে কোনো তরকারি ছিল না। তাই বঁটি নিয়ে লাউটা পাড়তে এসেছিল সে। লাউ গাছের কাছে এসে দু'জনে মুখোমুখি হয়ে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো ঝগড়া। এ যেন ঝগড়া না, রীতিমতো সম্মুখ যুদ্ধ। ঝগড়া তুমুল পর্যায়ে পৌঁছে গেল। কেউ কাউকে একবিন্দুও ছাড় দিল না। কিছুদিন তারা যে একসঙ্গে ছিল, একচুলোয় একহাঁড়িতে রান্না করা ভাত খেত তারা যে একে অপরের জা, তাদের স্বামী দু'জন যে আপন দুই ভাই- সে কথাও ভুলে গেল। একজন অপরজনের বাপের বাড়ির দুর্বল দিকগুলো উলেস্নখ করে কথার যুদ্ধে পরাজিত করতে চাইল। ঠিক এমন সুসময়ে গোয়ালঘর থেকে লাল রংয়ের গরুটা বের হয়ে পুরো লাউগাছটা খেয়ে সাবাড় করে দিল। যখন গাছের দিকে দু'জনের খেয়াল হলো ততক্ষণে পুরো গাছ তো বটে; লাউটাও অর্ধেক গরু গলাধঃকরণ করে ফেলেছে।
তারপর দু'জনে ঝগড়া থামিয়ে গরুটার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল।