সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২

নারীর ক্ষমতায়ন

নন্দিনী ডেস্ক
  ০৪ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
নারীর ক্ষমতায়ন
নারীর ক্ষমতায়ন

জাতিসংঘের মতে, ক্ষমতায়ন এমন একটি প্রক্রিয়া- যার দ্বারা নারী কল্যাণ, সমতা এবং সম্পদ আহরণের সমান সুযোগ অর্জনের লক্ষ্যে জেন্ডার বৈষম্য অনুধাবন, চিহ্নিতকরণ ও বিলোপ সাধনের জন্য একজোট। নারীর ক্ষমতায়নের স্স্নোগানটি সর্বপ্রথম উচ্চারিত হয় ১৯৭৫ সালে মেক্সিকোতে বিশ্ব নারী সম্মেলনে। এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল নর-নারীর অধিকার সংরক্ষণ নীতি। এ নীতির মূল বিষয় ছিল নারীর ক্ষমতায়ন। বর্তমান শতাব্দীতে নারীর ক্ষমতায়ন একটা আন্তর্জাতিক বিষয়। ১৯৯৫ সালে চীনের বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত বিশ্ব নারী সম্মেলনে ঘোষিত চষধঃভড়ৎস ভড়ৎ অপঃরড়হ-এর ১৩ অনুচ্ছেদে নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে একটি বড় ধরনের রোডম্যাপ তৈরি হয়। এটি পরবর্তী সময়ে নারীর ইতিবাচক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। নারী মানবসমাজের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ও মানবীয় জীবনযাপন প্রণালির সাক্ষী। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রগুলো হলো পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকান্ডে, অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায়, পরিকল্পনা প্রণয়নে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে, শিক্ষা কর্মকান্ডে, গবেষণা কর্মকান্ডে, সৃজনশীল উদ্ভাবনীতে এবং সেবা সার্ভিস ইত্যাদি ক্ষেত্রে। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, 'নারী সৃষ্টির আধার'। প্রাকৃতিক, জৈবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ইতিবাচক রূপান্তরে বা বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় নারী জড়িয়ে আছে আবহমান কাল থেকেই। যে সমাজে মেয়েদের ক্ষমতায়ন যত বেশি হয়েছে, সে সমাজ তত বেশি উন্নত হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল। আর্থসামাজিক উন্নয়ন অর্থাৎ মানবিক ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীর অংশগ্রহণের ভূমিকা ও অবদান অবিস্মরণীয়। দেশের কৃষি, গ্রামীণ অর্থনীতি, পোশাক শিল্প, অনলাইন ব্যবসা, করোনাকালীন দুর্যোগ মোকাবিলায়, করোনাকালীন অর্থনৈতিক গতি প্রবাহ উন্নয়ন অগ্রগতিসহ দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক মানবিক কর্মকান্ডে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে নারী সমাজ। নারীর ক্ষমতায়ন সুপ্রতিষ্ঠত হলে নারী প্রতিটি ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি বয়ে নিয়ে আসবে বিশ্বসমাজে। বেগম রোকেয়া বলেছেন, 'কন্যাগুলোকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্ন-বস্ত্র উপার্জন করুক।'

সময় বদলাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে। সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এভাবে সমতা বিধান সম্ভব হলে, নারীর ক্ষমতায়ন সুপ্রতিষ্ঠিত হলে, পরিবার পরিকল্পনায় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে, ভোটদানের ক্ষেত্রে, সামরিক বাহিনীর কাজে, আইনগত চুক্তিতে অংশগ্রহণে, বিয়ে ধর্মীয় অধিকারসমূহ অন্য সব অধিকার বলবৎ হলে নারীর সুকুমার বৃত্তি প্রস্ফুটিত হবে। বর্তমান সময়ে গ্রামীণ কৃষি কাজের প্রায় ৪৬ শতাংশই নারীরা সম্পাদন করে। কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত ২১টি ধাপের মধ্যে ১৭টি ধাপে কাজ করেন নারীরা এবং ফসল তোলার কাজের সঙ্গে ৬৮ শতাংশ নারী যুক্ত। এছাড়া, নারীরা শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে এবং উদ্যোক্তা হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করেছে। গ্রামীণ পরিবেশে নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবে বহুমুখী অবদান রাখছে। জাতিসংঘ নারীর গৃহকর্মে শ্রমমূল্য ও মর্যাদা বিষয়ক মানবিক দাবি নির্ধারণ করেছে। গৃহকর্মে অবদান প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিডিসি)-এর ২০১৮ সালে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, গৃহ ও গৃহস্থালি কর্মে নারীরা নীরব অবদানের অর্থমূল্য প্রায় ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান বু্যরোর প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, সংসারে একজন নারী পুরুষের তুলনায় ৩ গুণ বেশি মজুরির কাজ করে। গৃহকর্মে নারী দৈনিক সময় ব্যয় করে ৭.৭ ঘণ্টা এবং পুরুষ ব্যয় করে ২.২ ঘণ্টা। জাতিসংঘ গার্হস্থ্য শ্রমকে যদি অর্থের হিসাব বিবেচনা করা হতো তবে যে কোনো দেশের জাতীয় আয় ৩৯ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি হতো। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সূচক বলছে, বাংলাদেশে লিঙ্গ সমতায় দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম স্থান অর্জন করেছে। আর এই সমতা নারীর অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ, শিক্ষার হার, স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশকে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মাধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত হওয়ার পেছনে নারীর ভূমিকাই অগ্রগণ্য। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে নারীরা। এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট (এসিডি)-এর জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট প্রায় ৪২ লাখ ২০ হাজার পোশাক শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ ৯৮ হাজার। ১৯৯১ সাল থেকে হাজার হাজার নারী প্রবাসে কাজ করছে। দেশে মোট কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় কৃষি কাজে নিয়োজিত। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়ার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস সূত্রে বর্তমানে দেশে ৩ লাখ মানুষ অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনা করছে। এদের অর্ধেকই নারী। অর্থনীতির ভিত্তি হচ্ছে কৃষি, সেই ঐতিহাসিক কৃষির গোড়াপত্তন করেছিলেন নারীরা। কৃষি, আবহাওয়া ও জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত নানাবিধ বিষয় প্রবাদ-প্রবচন, খনার বচন কৃষি তথা ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ সম্পর্কিত বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে দিক-নির্দেশনা সমাজকে আধুনিকতার দিকে ক্রমান্বয়ে ধাবিত করেছে এই নারীরা। ঐতিহাসিক কাল থেকেই নারী তার মেধা 'মননশীলতা ও বীরত্বে'র তথা সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকান্ডে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। সাঁওতাল বিদ্রোহের অগ্রভাগে ছিলেন বাংলার নারীরাই। বাংলার নারী মুক্তির অগ্রদূত ছিলেন ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ইলামিত্র, সুফিয়া কামাল, বেগম রোকেয়া। এছাড়া, শহীদ জননী খ্যাত জাহানারা ইমাম এক বিপস্নবী চরিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র। ফ্যাশন দুনিয়ার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী আন্তর্জাতিক ফ্যাশন মডেল ও ডিজাইনার বিবি রাসেল, পর্বতারোহীদের মধ্যে আদর্শ নিশাত মজুমদার। ইতিহাসখ্যাত ফরাসি বিপস্নবেও নারীদের উলেস্নখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়; তাদের মধ্যে তারামন বিবি, ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম, যশোরের রোকেয়া খাতুন, কিশোরগঞ্জের সখিনা বেগম। নারীরা যাতে আত্মবিশ্বাসী, আত্মমর্যাদাশীল, সাহসী, স্বাধীনচেতা, যুক্তিবাদী, ন্যায়ের প্রতীক, যোগ্যতাসম্পন্ন, দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে তৈরি হয়ে যথাযথ অধিকার প্রাপ্তিতে সমাজের সবাইকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই মানবতার জয় হবে। লালন বলেন, 'সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেন সবাইকে, কিন্তু যুগে যুগে মাতা হন যোগেশ্বরী।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে