শুক্রবার, ৩০ মে ২০২৫, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আমরা ইউনিভার্স না মাল্টিইউনিভার্সের বাসিন্দা!

এই মহাবিশ্ব ঠিক কত বড় সেই আয়তন ফিতা মেপে বলা সম্ভব না হলেও অনুমান করা যায়। আর তাতেই আমাদের বিস্ময়ের সীমা থাকে না। কিন্তু এর সঙ্গে যদি বলা যায়, আমাদের মহাবিশ্ব অনেক বা অসংখ্য মহাবিশ্বের একটি অংশ তাহলে চোখ কপালে ওঠার কথা। সত্যি বলতে এ রকম একটি ধারণা পদার্থ বিজ্ঞানে রয়েছে, বৈজ্ঞানিক মহলেও রয়েছে এবং এটি উড়িয়ে দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। কারণ মানুষ তার আবিষ্কার কোথায় গিয়ে শেষ করবে সেটা নিজেও জানে না। অনেক মহাবিশ্ব থাকলে পৃথিবীর অস্তিত্ব কোথায় এ প্রশ্নও উঠতে পারে।
অলোক আচার্য
  ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
আমরা ইউনিভার্স না মাল্টিইউনিভার্সের বাসিন্দা!
আমরা ইউনিভার্স না মাল্টিইউনিভার্সের বাসিন্দা!

বিজ্ঞানে শেষ কথা বলে কিছু নেই। আপনি বা আমি আজ যা অসম্ভব বলে ভাবছি, কাল সেটা সম্ভব হতেই পারে। আমরা ভাবছি এটাই হয়তো শেষ সত্যি; আসলে এর পেছনেও আরও সত্য লুকিয়ে আছে। পৃথিবীর মতো পৃথিবী থাকতে পারে এবং বিজ্ঞানীরা তা খুঁজছে, সেভাবেই মহাবিশ্বের মতোই মহাবিশ্ব থাকতে পারে। আমরা যেমন একদেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করছি, এরপর হয়তো এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে যাব এবং এরপর এক মহাবিশ্ব থেকে অন্য মহাবিশ্বে যাব! বিস্ময় জাগতে পারে, তবে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেওয়ার কিছু নেই।

বিজ্ঞানে এটাই বাস্তব। পৃথিবী মহাবিশ্বের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। এই মহাবিশ্ব ঠিক কত বড় সেই আয়তন ফিতা মেপে বলা সম্ভব না হলেও অনুমান করা যায়। আর

1

তাতেই আমাদের বিস্ময়ের সীমা থাকে না। কিন্তু এর সঙ্গে যদি বলা যায়, আমাদের মহাবিশ্ব অনেক বা অসংখ্য মহাবিশ্বের একটি অংশ তাহলে চোখ কপালে ওঠার কথা। সত্যি বলতে এরকম একটি ধারণা পদার্থ বিজ্ঞানে রয়েছে, বৈজ্ঞানিক মহলেও রয়েছে এবং এটি উড়িয়ে দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। কারণ মানুষ তার আবিষ্কার কোথায় গিয়ে শেষ করবে সেটা নিজেও জানে না। অনেক মহাবিশ্ব

থাকলে পৃথিবীর অস্তিত্ব কোথায় এ প্রশ্নও উঠতে পারে। মহাবিশ্ব আলোর গতির চাইতেও চতুর্দিকেই প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্বের আয়তন হচ্ছে ৯৩-বিলিয়ন লাইট ইয়ার্স। ৯৩-বিলিয়ন লাইট ইয়ার্স আয়তনের মহাবিশ্ব প্রতি সেকেন্ডে লাইট ইয়ার্সের চাইতেও দ্রম্নত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার মানে এই মহাবিশ্বের বাহিরে কি পরিমাণ জায়গা থাকলে এমন বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব। যদি বিষয়টা এমনি হয় তাহলে নিশ্চিতভাবেই মহাবিশ্বের বাহিরেও বাড়তি জায়গা আছে।

বাড়তি জায়গা আছে মানেই সেই বাড়তি জায়গায় আরো অনেক অনেক কিছুই থাকতে পারে। মানে, বলতে চাইছি- এই বাড়তি জায়গায় কিন্তু আরও মহাবিশ্ব থাকতে পারে। হঁ্যা, সেটা মানুষের এখনো পর্যন্ত আন্দাজ, একেবারে স্পষ্ট প্রমাণ নেই, কিন্তু থাকতে পারে- এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ, সেই শূন্যস্থানে কী আছে সে উত্তরও তো নেই। মহাবিশ্ব যে প্রসারিত হচ্ছে, এত জায়গা পাচ্ছে কোথায়?

এখান থেকেই মাল্টিভার্স অনুমান করা এবং গবেষণা করা। সম্প্রতি গুগুলের গবেষণায় মিলেছে এর পক্ষে প্রমাণ। সেটা নিয়েই গোটা দুনিয়ায় পড়েছে হৈ চৈ। তাদের কোয়ান্টাম চিপ 'উইলা'র মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, মাল্টিভার্সের ধারণা হয়তো এখন আর শুধু তত্ত্ব নয়; বরং তা বাস্তবের কাছাকাছি গুগলের গবেষণা দল কোয়ান্টাম প্রযুক্তির সাহায্যে এমন এক অভাবনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে- যা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ধারণাকে আমূল বদলে দিতে পারে। 'উইলা' কোয়ান্টাম চিপ, যা আল্ট্‌ধসঢ়;রা-অ্যাডভান্সড প্রসেসিং ক্ষমতাসম্পন্ন- এমন কিছু গাণিতিক প্যাটার্নের সন্ধান দিয়েছে- যা আমাদের মহাবিশ্বের বাইরে আরও সমান্তরাল মহাবিশ্বের উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। গুগলের গবেষণা শুধু কল্পনা নয়, বরং এটি জটিল বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও গাণিতিক মডেলের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত।

গুগলের 'উইলা' চিপ মাত্র পাঁচ মিনিটে এমন গণনা করতে সক্ষম হয়েছে- যাআধুনিক সুপার কম্পিউটারও করতে কয়েক লাখ বছর লাগবে। গবেষণার ফল বলছে, আমরা এমন একটি বাস্তবতায় বাস করছি- যা একইসঙ্গে অসংখ্য মহাবিশ্বের প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত। গবেষকরা বলছেন, 'আমরা এখন পর্যন্ত যা ভেবেছি, তার চেয়ে মহাবিশ্ব অনেক বিস্তৃত এবং জটিল। সমান্তরাল মহাবিশ্বে আমাদের অস্তিত্বের সম্ভাবনা বিজ্ঞানকে নতুন দিকে নিয়ে যাবে।' পৃথিবীর মতো একাধিক বাসযোগ্য গ্রহ বা প্রাণী থাকার বিষয়ে বা এরকম মহাবিশ্ব আরও থাকার ধারণা মানুষের বহু পুরাতন। পার্থক্য হলো- এখন যেমন মানুষ গবেষণা করে বিষয়টার একটা যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করে অথবা প্রমাণ করতে পারে তখন সেসব ছিল অনুমান নির্ভর। তবে কিছু যুক্তি ছিল যা নিজস্ব। সেখান থেকেই আজ এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বহু মহাবিশ্বের ধারণা নতুন নয়, এ নিয়ে বিজ্ঞান কল্পকাহিনীও লেখা হয়েছে। বিশ্বকে বা মহাবিশ্বকে জানার আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরকালের। তবে, মানুষকেবল এই বিশ্ব নিয়ে জানতে বা গবেষণা করতেই বসে নেই, মানুষ ছুটছেমহাবিশ্বের টানে এবং বলা যায় মহাবিশ্ব থেকে মহাবিশ্বের পথে। এই মহাপথ কত লম্বা তা জানা নেই, তবে বিজ্ঞান থেমে থাকে না। এই মহাবিশ্বেও গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালক্সি, ছায়াপথ, ধূমকেতু সবকিছু নিয়েই মানুষ জানতে আগ্রহী। ঠিক এই মহাবিশ্বের মতোই অন্য কোনো মহাবিশ্বেও রয়েছে এরকম গ্রহ, উপগ্রহ, গ্যালাক্সি, নক্ষত্র ইত্যাদি। তাহলে মানুষ? থাকতেই পারে এবং সেটাই তো স্বাভাবিক। এমনকি আমি এবং আপনিও থাকতে পারেন। জ্যোতির্বিদরা মনে করছেন যে, দৃশ্যমান মহাবিশ্বে প্রায় ১০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে।

এই ১০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সিতে আবার রয়েছে অসংখ্য নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ,ধূমকেতু, নিহারিকা ইত্যাদি। থাকার কথা প্রাণ ও প্রাণীও। মানুষ জানতে চায় কীভাবে এই মহাবিশ্বের জন্ম হলো, প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হলো কীভাবে, প্রথম আলোর বিচ্ছুরণ কেমন ছিল এসব মানুষের আগ্রহের বিষয়বস্তু। এই বিশ্ব হলো বিশাল মহাবিশ্বের একটু ক্ষুদ্র অংশমাত্র। স্যার এডিংটনের মতে, প্রতি গ্যালাক্সিতে গড়ে ১০ সহস্রকোটি নক্ষত্র রয়েছে। বিভিন্ন তত্ত্ব এবং তথ্য দিয়ে মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটি ধারণা দাঁড় করানো হয়েছে মাত্র। তবে মানুষ থেমে নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত হওয়ার পর থেকেই মানুষ চেষ্টা করছে মহাবিশ্বের রহস্য জানার। অনন্ত নক্ষত্রবিথীর দিকে তাকিয়ে সেই রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছে মানুষ।

তবে, এই অনন্ত মহাবিশ্বের রহস্যের খুব কমই এখন পর্যন্ত মানুষের চোখের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। এই তো এসব রহস্য জানতে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও বড় টেলিস্কোপ মহাকাশে যাত্রা করেছে সফলভাবে। এই টেলিস্কোপ দিয়ে বিজ্ঞানীরা বহুদিনের এই মহাবিশ্বের অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়।

মহাবিশ্ব নিয়ে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগে ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির পর এখন যা যা আছে গ্যালাক্সি, গ্রহ ইত্যাদি ছাড়াও মানুষ কীভাবে এলো সেটাও জানতে চায়। বিগ ব্যাং মডেল অনুযায়ী মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল একটি ভীষণ ঘন ও উষ্ণ অবস্থা থেকে। তারপর থেকে এটি সম্প্রসারমান। এর ফলে, এক গ্যালাক্সি অন্য গ্যালাক্সি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

বর্তমানের এই টেলিস্কোপটি হাবল টেলিস্কোপের উত্তরসূরি। এই টেলিস্কোপটি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে সাড়ে পাঁচশ কিলোমিটার উঁচুতে ছিল। এই মহাবিশ্বের রয়েছে অনন্ত রহস্য। আর যদি বহু মহাবিশ্বের ধারণাটি আমরা স্বীকার করি তাহলে এই রহস্য আরও গভীর থেকে গভীরে যায়। এই রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছে গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ। হতে পারে মানুষের চেয়েও বুদ্ধিমান প্রাণী রয়েছে। অন্য গ্রহের প্রাণীদের আমরা এলিয়েন বলেই জানি। এসব এলিয়েন কেমন হবে

তাও আমরা জানি হলিউড-বলিউডে নির্মিত সিনেমা বা সিরিয়াল দেখে।

ভূরি ভূরি সিনেমা নির্মাণ হয়েছে ভিনগ্রহের প্রাণীদের নিয়ে। ভিনগ্রহের প্রাণীরা কেমন হবে? ওরা কি জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানুষের চেয়েও উন্নত হবে? এমন ধারণা থেকেই বহু সিনেমা নির্মিত হয়েছে। ভিনগ্রহের প্রাণীদের ব্যবহৃত যানকে আমরা বলি ফ্লাইং সসার। পৃথিবীতে ফ্লাইং সসারের আসার খবর বহু যুগ আগে থেকেই মানুষের জানা আছে। গোল চাকতির মতো একটি যান- যা মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে যায়। ক্রমেই প্রসারিত হওয়া এই মহাবিশ্বে কতদিন মানুষই সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে পরিচিত সেটা একটি প্রশ্ন।

তবে পৃথিবীর বাইরে বসবাসের উপযুক্ত একটি নিরাপদ বাসস্থান খোঁজার এই প্রচেষ্টা কি শুধুই কৌতূহল থেকে না এর পেছনে অন্যকোনো উদ্দেশ্যও রয়েছে? প্রথমত, কৌতূহল তো বটেই। কারণ বিজ্ঞান মানেই তো কৌতূহল। আজ পর্যন্ত যা হয়েছে সবই মানুষের কৌতূহল থেকেই হয়েছে। তবে কৌতূহলের বাইরেও রয়েছে মানুষের প্রয়োজন। বলা হয়, প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভাবনের জনক। একদিন হয়তো সেই রহস্য ভেদ করা সম্ভব হবে। মানুষ জানতে পারবে এই মহাবিশ্বের রহস্য! মহাবিশ্বের রহস্য ভেদ করে মানুষ ছুটবে আরেক মহাবিশ্বের খোঁজে। তারপর আরেক মহাবিশ্ব! আমরা কতটা ক্ষুদ্র সেটা যদি মাল্টিইউনিভার্সের ধারণায় একবার প্রবেশ করেন তাহলেই বুঝতে পারবেন!

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে