যখনই নতুন কোনো প্রযুক্তি এসেছে সেটাই পর্র্নগ্রাফির হাতিয়ার হয়েছে। প্রাচীন গ্রিকরা মাটির আসবাবপত্রে বিভিন্ন অশ্লীল ছবি আঁকত। কাগজ আবিষ্কারের পর সেই ছবিগুলো চলে এলো কাগজে। ১৯৪৮ সালে ড. আলফ্রেড কিন্সে বিকৃত যৌনাচার নিয়ে খুব জনপ্রিয় একটি বই লিখেছিল। ১৯৫৩ সালে বের হয়েছিল হিউ হেফনারের বিশেষ অশ্লীল ম্যাগাজিন। একটা সময় মানুষ থিয়েটারে গিয়ে পর্র্নগ্রাফির মতো অশ্লীল ছবি দেখত। ১৯৮০ সালে ঈদ আসার পর ঘরে বসে বসে পর্র্ন দেখা শুরু হলো। এরপর এলো ইন্টারনেট, পাল্টে দিল ইতিহাসের গতিপথ। ইন্টারনেটে প্রথম পর্র্ন আসা শুরু করে ১৯৯০ সালে। অনলাইন পর্র্ন ইন্ডাস্ট্রির প্রসার। দ্রম্নতই ইন্টারনেটে থাকা তথ্যের ৩০ শতাংশ দখল করে নিল পর্র্ন। পর্ন ইন্ডাস্ট্রির আয় গরপৎড়ংড়ভঃ, এড়ড়মষব, ণধযড়ড়, অসধুড়হ, ঊনধু, অঢ়ঢ়ষব, ঘবঃভষরী ঊধৎঃযষরহশ-এর মিলিত আয়ের কয়েকগুন হয়ে দাঁড়াল। ১৯৯২ সালে প্রথম ওইগ কোম্পানি স্মাট ফোন নিয়ে এলো। ধীরে ধীরে পর্র্ন চলে এলে মানুষের হাতের মুঠোয় এখন এই অন্ধকার জগতে প্রবেশের জন্য একটি ক্লিকই যথেষ্ট। জীবনে চলার পথে প্রযুক্তি আমাদের ব্যবহার করতেই হবে কিন্তু পর্র্ন যতদিন আছে এতে জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়ে যাচ্ছে। কিশোর থেকে বৃদ্ধ, তরুণ থেকে তরুণী সব বয়সের মানুষই আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। ২০১২ সালে যমুনা টিভি কয়েকটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণির কিছু ছাত্রছাত্রীর ওপর চালানো জরিপ অনুসারে দেখা যায়, শতকরা ৭৬ জন শিক্ষার্থীর নিজের ফোন আছে। বাকিরা বাবা- মায়ের ফোন ব্যবহার করে। এদের মধ্যে ৮২ শতাংশ সুযোগ পেলে মোবাইলে পর্র্ন দেখে, ক্লাসে বসে পর্ন দেখে ৬২ শতাংশ, ৭৮ শতাংশ গড়ে ৮ ঘণ্টা মোবাইলে ব্যয় করে এবং ৪৩ শতাংশ প্রেম করার উদ্দেশ্যে মোবাইল ব্যবহার করে। বেসরকারি হিসাবে দেখা যায়, গান, রিংটোন এবং ফটোকপির দোকানগুলোর মাধ্যমে দেশে দৈনিক ২.৫ কোটি টাকার পর্ন বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও বাংলাদেশ থেকে একমাসে গুগলে 'পর্ন' শব্দটি সার্চ করা হয়েছে ০.৮ মিলিয়ন বারেও বেশি। ৩০ জুলাই, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (ইঝঝ) পর্নগ্রাফির ওপর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ঢাকার সাইবার ক্যাফেগুলো থেকে প্রতিমাসে বিভিন্ন বয়সের মানুষ যে পরিমাণ পর্র্ন ডাউনলোড করে তার মূল্য ৩ কোটি টাকার মতো।
এখন প্রতিকার কি? প্রতিকার পেতে হলে যেসব বিষয় অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে;
১. আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি করা: প্রথমেই আসক্তি সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং এটি আপনার জীবনে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে তা বোঝা জরুরি। নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি কেন এবং কখন পর্নোগ্রাফি দেখতে আগ্রহী হন।
২. পরিকল্পনা এবং লক্ষ্য নির্ধারণ : নিজেকে ঠিক করুন। আপনি কীভাবে ধীরে ধীরে এই অভ্যাস থেকে মুক্তি পেতে চান। দৈনন্দিন জীবনে কীভাবে পর্নোগ্রাফি থেকে নিজেকে দূরে রাখবেন তার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করুন।
৩. পরিবেশ পরিবর্তন : যেসব পরিস্থিতি, স্থান বা প্রযুক্তি আপনার পর্নোগ্রাফি দেখার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয় সেগুলো থেকে নিজেকে সরিয়ে নিন। যেমন, রাতের বেলায় একা থাকা অবস্থায় ইন্টারনেট ব্যবহার এড়িয়ে চলা বা ফিল্টার সফটওয়্যার ব্যবহার করা।
৪. ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ: অনলাইন কনটেন্টের প্রতি নিয়ন্ত্রণ আনতে পর্র্ন-বস্নকিং সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারেন। যেমন, 'ঈড়াবহধহঃ ঊুবং', 'ঘবঃ ঘধহহু' ইত্যাদি। এছাড়া, আপনার ইন্টারনেট ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করুন।
৫. নতুন অভ্যাস গড়ে তোলা : নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য নতুন কোনো শখ বা আগ্রহের দিকে মনোযোগ দিন। শরীরচর্চা, পড়াশোনা, সৃজনশীল কাজ, অথবা কোনো সামাজিক কাজে নিজেকে জড়িত রাখুন।
৬. মেডিটেশন এবং মানসিক প্রশান্তি: মনকে শান্ত করতে ধ্যান বা মেডিটেশন চর্চা করতে পারেন। এর মাধ্যমে মানসিক চাপ কমে এবং আসক্তি কাটানো সহজ হয়। নিয়মিত ধ্যান করলে আপনার মনোযোগ বাড়বে এবং ক্ষতিকর অভ্যাসগুলো থেকে দূরে থাকতে পারবেন।
৭. পরিবার এবং বন্ধুদের সমর্থন : পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে নিজের সমস্যা নিয়ে কথা বলুন। তাদের সমর্থন এবং উৎসাহ আপনাকে এই আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে।
৮. পেশাদার সাহায্য : যদি প্রয়োজন হয়, একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সেলরের সাহায্য নিন। তারা আপনার জন্য উপযুক্ত থেরাপি বা কাউন্সেলিং সেশন প্রস্তাব করতে পারবেন।
৯. ধৈর্য এবং নিয়মিত প্রচেষ্টা : এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। ধৈর্য ধরে নিয়মিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। মাঝে মাঝে ব্যর্থতা হতে পারে, তবে এতে হতাশ না হয়ে পুনরায় চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
১০. দৈনন্দিন নিয়ম তৈরি করা : আপনার দৈনন্দিন জীবনের জন্য একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ রুটিন তৈরি করুন। এতে অবসর সময়ে অপ্রয়োজনীয় কাজের দিকে মনোযোগ কমে আসবে এবং আপনি আসক্তির প্রতি নিয়ন্ত্রণ আনতে পারবেন।
এই ধাপগুলো মেনে চললে ধীরে ধীরে আপনি পর্র্নগ্রাফির আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে পারবেন।