বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২

বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটহীন নবাব আনোয়ার হোসেন

নায়ক চরিত্রে আনোয়ার হোসেনের আত্মপ্রকাশ ঘটে 'সুর্যস্নান' সিনেমা দিয়ে। যেটি নির্মাণ করেছিলেন সালাহউদ্দিন। এরপরই নায়ক তথা ইতিবাচক চরিত্রে আনোয়ার হোসেন পরিচিত হয়ে ওঠেন। ষাটের দশকের প্রথম পাঁচ বছরে আনোয়ার হোসেন অন্তত দেড় ডজন সিনেমায় অভিনয় করেছেন। কিন্তু ব্যাপক পরিসরে জনপ্রিয়তা পাননি। তাকে তারকাখ্যাতি এনে দিয়েছিল ১৯৬৭ সালের সিনেমা 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা'। বাংলার শেষ নবাবের জীবন অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমা দেশের সমস্ত প্রান্তে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই সিনেমায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার ভূমিকায় অভিনয় করে আনোয়ার হোসেন কাঙ্ক্ষিত জনপ্রিয়তা বা সাফল্যের দেখা পান।
তারার মেলা রিপোর্ট
  ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটহীন নবাব আনোয়ার হোসেন
বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটহীন নবাব আনোয়ার হোসেন

দীর্ঘ ৫২ বছর তিনি অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত সিনেমার সংখ্যা পাঁচশ'র বেশি। অনবদ্য অভিনয়ে মুগ্ধ করেছেন দেশের মানুষকে। গ্রাম-বাংলার দর্শকদের কাছে তার আলাদা গ্রহণযোগ্যতা, পরিচিতি, জনপ্রিয়তা ছিল। নায়ক থেকে বাবা, দাদার চরিত্রে এসেও সমান তালে দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি। তার হৃদয়ছোঁয়া অভিনয় দাগ কেটেছে সবার মনেই। বলছি, মুকুটহীন নবাব আনোয়ার হোসেনের কথা। দেশের সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় ও খ্যাতিমান অভিনেতা তিনি। ঢালিউড ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলা কিংবা মুকুটহীন নবাব নামেও খ্যাত।

১৯৩১ সালের ৬ নভেম্বর জামালপুর জেলার মুরুলিয়া গ্রামের মিয়াবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন আনোয়ার হোসেন। তার বাবা এ কে এম নাজির হোসেন ছিলেন জেলা সাব-রেজিস্ট্রার। তার মায়ের নাম সাঈদা খাতুন। আনোয়ার হোসেন যখন প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র, তখন থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হন। ১৯৪০ সালে তিনি দেওয়ানগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। সেই স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আনোয়ার হোসেন ছিলেন সরব। এরপর জামালপুর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন।

ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে ভর্তি হওয়ার পর মঞ্চ নাটকের সঙ্গে যুক্ত হন আনোয়ার হোসেন। কলেজের প্রথম বর্ষে থাকাকালীন আসকর ইবনে সাইখের 'পদক্ষেপ' নাটকে অভিনয় করেন তিনি। এর পর থেকেই অভিনয়ের প্রতি আনোয়ার হোসেনের দুর্বার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। কিন্তু চাইলেও তখন থেকে অভিনয়ে নিয়মিত হতে পারেননি আনোয়ার হোসেন। কলেজের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে বাবার বন্ধু আবদুলস্নাহ খানের 'সেলকন ইঞ্জিনিয়ারিং' ফার্মে সুপারভাইজারের চাকরি নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। তবে এই চাকরি নিয়ে ঢাকা আসার পেছনে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল অভিনয় করা। তাই ঢাকায় এসে তিনি নাটকের ভুবনে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন। বেতারে অডিশন দেন এবং নির্বাচিত হন 'হাতেম তাই' নাটকের জন্য। যদিও তাতে আনোয়ার হোসেনের চরিত্রটি ছিল খুব ছোট।

ধীরে ধীরে আনোয়ার হোসেন মঞ্চ নাটকের পরিচিত ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে ঝিনুক পত্রিকার সম্পাদক আসিরুদ্দিনের সহযোগিতায় মিনার্ভা থিয়েটার গঠন করেন তিনি। এই থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হন সৈয়দ হাসান ইমাম, ফতেহ লোহানী, মেহফুজ, সুভাষ দত্ত, চিত্রা সিনহাসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। মঞ্চ নাটকে আনোয়ার হোসেনের দুর্দান্ত অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন পরিচালক মহিউদ্দিন। সেই সুবাদে ১৯৬১ সালে মহিউদ্দিনের 'তোমার আমার' সিনেমায় ভিলেনের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান আনোয়ার হোসেন। তার অভিনয় নজর কাড়ে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের।

নায়ক চরিত্রে আনোয়ার হোসেনের আত্মপ্রকাশ ঘটে 'সুর্যস্নান' সিনেমা দিয়ে। যেটি নির্মাণ করেছিলেন সালাহউদ্দিন। এরপরই নায়ক তথা ইতিবাচক চরিত্রে আনোয়ার হোসেন পরিচিত হয়ে ওঠেন। ষাটের দশকের প্রথম পাঁচ বছরে আনোয়ার হোসেন অন্তত দেড় ডজন সিনেমায় অভিনয় করেছেন। কিন্তু ব্যাপক পরিসরে জনপ্রিয়তা পাননি। তাকে তারকাখ্যাতি এনে দিয়েছিল ১৯৬৭ সালের সিনেমা 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা'। বাংলার শেষ নবাবের জীবন অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমা দেশের সমস্ত প্রান্তে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই সিনেমায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার ভূমিকায় অভিনয় করে আনোয়ার হোসেন কাঙ্ক্ষিত জনপ্রিয়তা বা সাফল্যের দেখা পান।

আনোয়ার হোসেন অভিনীত সিনেমাগুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে- 'সূর্যস্নান', 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা', 'জীবন থেকে নেয়া', 'জয় বাংলা', 'অরুণোদ্বয়ের অগ্নিসাক্ষী', 'লাঠিয়াল', 'পালঙ্ক', 'গোলাপী এখন ট্রেনে', 'সুন্দরী', 'সখিনার যুদ্ধ', 'নাজমা', 'সূর্যগ্রহণ', 'সূর্যসংগ্রাম', 'দায়ী কে', 'সত্য মিথ্যা', 'নয়নমণি', 'ভাত দে', 'চাকর', 'অনন্ত ভালোবাসা' ইত্যাদি। তাকে সর্বশেষ কাজী মোরশেদ পরিচালিত 'ঘানি' সিনেমায় দেখা গিয়েছিল।

ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাহিত্যনির্ভর, শিশুতোষ, লোককাহিনীভিত্তিক, পোশাকি ফ্যান্টাসি, পরিচ্ছন্ন সামাজিক, পারিবারিক মেলোড্রামা, বক্তব্যধর্মী- সব ধরনের সিনেমাতেই অভিনয় করেছেন আনোয়ার হোসেন। দেশের বিখ্যাত সব নির্মাতার সিনেমায় দেখা গেছে তাকে। এই তালিকায় আছেন- খান আতাউর রহমান, কাজী জহির, আমজাদ হোসেন, ইবনে মিজান, আলমগীর কবির, জহির রায়হান, নারায়ণ ঘোষ মিতা, সুভাষ দত্ত, নজরুল ইসলাম, চাষী নজরুল ইসলাম, কাজী হায়াতের মতো কিংবদন্তি নির্মাতারা।

সমৃদ্ধ অভিনয় জীবনে আনোয়ার হোসেনের প্রাপ্তি কম নয়। দর্শকদের অকৃত্রিম ভালোবাসার পাশাপাশি তিনি অর্জন করেছেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননাও। দেশের ইতিহাসে প্রথম অভিনেতা হিসেবে তিনি একুশে পদক লাভ করেছিলেন ১৯৮৮ সালে। এছাড়া, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তনের পর তিনিই শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে পুরস্কারটি তিনি লাভ করেন 'লাঠিয়াল' সিনেমার জন্য। এরপর তিনি 'গোলাপী এখন ট্রেনে' ও 'দায়ী কে?' সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব চরিত্রের অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০১০ সালে তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়। এছাড়াও আনোয়ার হোসেন দুইবার বাচসাস পুরস্কার এবং পাকিস্তানের নিগার পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা লাভ করেছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে আনোয়ার হোসেন বিয়ে করেছিলেন ১৯৫৭ সালে। তার স্ত্রীর নাম নাসিমা খানম। তিনি চার পুত্র ও এক কন্যার জনক। ২০১৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ৮১ বছর বয়সে মৃতু্যবরণ করেন আনোয়ার হোসেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে