মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২
বেসরকারি খাত

স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ নামল ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় চার বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো দেশের বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত, বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বকেয়া বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯.৮ বিলিয়ন ডলার যা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ ১৬.৪২ বিলিয়ন ডলার ছিল। এর আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে বকেয়া ঋণের পরিমাণ এরচেয়ে কম ৯.২ বিলিয়ন ডলার ছিল।
অর্থ-বাণিজ্য রিপোর্ট
  ০৮ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ নামল ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় চার বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো দেশের বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত, বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বকেয়া বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯.৮ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ ১৬.৪২ বিলিয়ন ডলার ছিল। এর আগে ২২০ সালের ডিসেম্বর শেষে বকেয়া ঋণের পরিমাণ এরচেয়ে কম ৯.২ বিলিয়ন ডলার ছিল।

এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ। ২০২১ সালের শেষে এক বছরের ব্যবধানে তা প্রায় ৬ বিলিয়ন বেড়ে ১৫.৪৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। সিনিয়র ব্যাংকাররা বিনিময় হারের অস্থিরতা, দেশের ক্রেডিট রেটিং হ্রাস এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর স্বল্পমেয়াদি ঋণের সীমা হ্রাসকে বেসরকারি খাতের বকেয়া স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ কমার জন্য দায়ী করেছেন।

তারা বলেন, অন্তর্র্ব‌তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগে গত দুই বছরে দেশের রিজার্ভ ক্রমাগত কমেছে। ফলে বাংলাদেশের প্রতি বিদেশি গ্রাহক ও ব্যাংকগুলোর আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়েছে।এছাড়া বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের কান্ট্রি রেটিং নেগেটিভ করায় আস্থার ঘাটতি আরও বেড়েছে। যার ফলশ্রুতিতে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ ধারাবাহিকভাবে কমছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ বকেয়া ছিল ১৬.৪২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এরপর থেকেই প্রায় প্রতি মাসেই কমেছে এর বকেয়া। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে বকেয়া ঋণ কমেছিল ২.৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালের জানুয়ারির তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এক বছরে বকেয়া ঋণ কমেছে প্রায় ১.৪৫ বিলিয়ন ডলার।

একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, 'আমরা এখন বিদেশি সরবরাহকারীদের কাছ থেকে আগের মতো ক্রেডিট লিমিট পাচ্ছি না। ফলে আগের মতো বেশি পরিমাণে ডেফারড [বিলম্বিত] ঋণপত্র (এলসি) খোলা সম্ভব হচ্ছে না। অবশ্য সুদহারে গেইন থাকার পরও বিনিময় হার নিয়ে আমদানিকারকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা থাকায় ডেফারড এলসি খোলার চাহিদাও কিছুটা কমেছে।'

সুদহারে গেইনের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে এ কর্মকর্তা বলেন, 'বর্তমানে সোফর (সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট) রেটের সঙ্গে প্রিমিয়াম যোগ করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঋণ বা লোনের জন্য প্রায় ৮ শতাংশ ইন্টারেস্ট দিতে হয়। অন্যদিকে আমাদের দেশে টাকার সুদের হার প্রায় ১২ শতাংশ। সে হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিলে ৪ শতাংশের মতো গেইন থাকে। তবে বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতার কারণে এই গেইন নিতে গ্রাহকরা উৎসাহ বোধ করছেন কম।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি শেষে ডেফারড পেমেন্ট বকেয়া ৬৪৩ মিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালের জানুয়ারি শেষে এটি ছিল ৯৭২ মিলিয়ন ডলার। স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ সবচেয়ে বেশি কমেছে বায়ারস ক্রেডিটে। ২০২৪ সালের জানুয়ারির ৫.৯৭ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে চলতি বছরের জানুয়ারি শেষে এটি ৫.০৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বায়ারস ক্রেডিট কমেছে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার।

সাধারণত বাংলাদেশের কোনো রপ্তানিকারক তার ক্রেতার কাছে থেকে ভবিষ্যতে পণ্য রপ্তানি করা হবে, এমন অর্ডারের বিপরীতে ঋণ নেন।

কমেছে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ

ব্যাংকাররা বলছেন, এখন ক্রেতারা আগের মতো দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিচ্ছে না। আগে ১ বছরের জন্য এমন ঋণ পাওয়া গেলেও এখন সেটি ৬ মাসে নেমে এসেছে। অন্য আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, অনেক ব্যাংকের ইউপিএএস এলসি (ইউজেন্স পেয়েবল অ্যাট সাইট এলসি) খোলা এবং গ্রাহকদের বায়ারস ক্রেডিট নেওয়ার সক্ষমতা কমে গেছে।

তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো আমাদের দেশের প্রায় সব ব্যাংকের ক্রেডিট লিমিটও কমিয়ে দিয়েছে। একইসঙ্গে অনেক ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনও কমে গেছে। অনেক বিদেশি ব্যাংক এমনও আছে যারা বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকের সঙ্গে লোন এক্সপোজারে যাচ্ছে না। যার ফলশ্রুতিতে সার্বিক বায়ারস ক্রেডিট কমছে।

প্রায় একই ঘটনা ঘটছে স্বল্পমেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রেও। গত এক বছরে বকেয়া স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন ডলার কমে ২০২৫ সালের জানুয়ারি শেষে ২.০৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকারদের মতে, বিদেশি ব্যাংকগুলো আগের মতো স্বল্পমেয়াদি ঋণ না দেওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোর বকেয়া কমছে। তবে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ভালো হওয়ায় এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি প্রায় ৩৪০ মিলিয়ন ডলার বেড়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হুসেইন বলেন, 'বিনিময় হার যখন অস্থিতিশীল থাকে, তখন আমদানিকারকরা সাইট এলসি খোলেন বেশি। এর কারণ হলো, ডেফারড এলসির ক্ষেত্রে বিনিময় হারের ঝুঁকি এবং কনফার্মেশন চার্জ উভয়ই থাকে। অন্যভাবে বললে, বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতা বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ কমার অন্যতম প্রধান কারণ।'

আন্তর্জাতিক সুদহার কমলে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধিকে কিছুটা উৎসাহিত করতে পারে উলস্নখ করে তিনি বলেন, সোফর রেট এখন আগের তুলনায় কিছুটা কম। তবে গ্রাহকরা আস্থা তৈরির জন্য স্থিতিশীল ডলার বাজার চান। সোহেল আরও বলেন, এখন রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি খুব ভালো, রপ্তানিও ভালো পারফর্ম করছে। এই দুটি খাত যদি ভালো করতে থাকে, তাহলে বিনিময় হারের ওপর চাপ কমবে।

তবে এই অভিজ্ঞ ব্যাংকার আরও বলেন, আগামী ৪-৫ মাসে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের ধারাবাহিকতায় কোনো উলেস্নখযোগ্য পরিবর্তন আশা করা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত বছর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (বিপিএম৬ অনুসারে) না বাড়লেও কমেনি। ২০২৪ সালের জানুয়ারি শেষে দেশের রিজার্ভ ছিল ১৯.৯৬ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ নাগাদও রিজার্ভ ১৯.৯৬ বিলিয়ন ডলারই রয়ে গেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে