রংপুরের কাউনিয়ায় টাকা চুরির সন্দেহে শামীম হোসেন (১০) ও রাসেল (৯) নামে দুই শিশুকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন চালিয়েছে এক ইউপি সদস্য ও তার দুই সহযোগী। ঘটনাটি ঘটেছে বুধবার উপজেলার টেপামধুপুর ইউনিয়নের রাজিব মোল্লাটারী গ্রামে। নির্যাতনের শিকার শিশু রাসেল গুরুতর আহত হলে তাকে সন্ধ্যায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে পরিবারের লোকজন।
নির্যাতনের শিকার শিশু শামীম উপজেলার টেপামধুপুর ইউনিয়নের রাজিব মোল্লাটারী গ্রামের সামসুল হকের ছেলে এবং রাসেল ওই ইউনিয়নের বাজেমজকুর গ্রামের মন্তাজ আলীর ছেলে।
স্থানীয়রা জানায়, গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে রাজিব মোল্লাটারী গ্রামের আকরাম হোসেনের ঘরের সিঁধ কেটে ৭০ হাজার টাকা কে বা কারা চুরি করে। এ ঘটনায় আকরাম এবং তার ভাই ইয়াকুব ও টাকা চুরি সন্দেহে একই এলাকার শিশু শামীম হোসেন ও বাজেমজকুর গ্রামের শিশু রাসেলকে বাড়ি থেকে ধরে আনে। এরপর ইউপি সদস্য ইউনুস আলী শিশু দুজনকে তার বাড়িতে ঘরের মধ্যে হাত-পা বেঁধে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করে। পরে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে ইউপি সদস্য ইউনুস আলীর বাড়ি থেকে দুই শিশুকে উদ্ধার করে পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হয়।
নির্যাতনের শিকার শিশু শামীম জানায়, ইউসুন মেম্বারের কথামতো প্রতিবেশী দুজন তাকে ধরে নিয়ে মেম্বারের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তার হাত-পা বেঁধে গাছের ডাল দিয়ে মারপিট করে ইউসুফ মেম্বার চাচা। মেম্বার চাচার পা ধরে বলেছিলাম আমি টাকা চুরি করি নাই। আমার কোনো কথাই শোনেননি। কোমর থেকে পায়ের গিরা পর্যন্ত গাছের ডাল দিয়ে মারপিট করেছে।
শামীমের মা সোহাগী বেগম জানান, সংসারের অভাবের কারণে শিশু শামীম একটি পিকআপে সহকারী হিসেবে কাজ করে। চার দিন পর মঙ্গলবার রাতে নওগাঁ থেকে বাড়িতে ফিরে খাওয়া শেষে গাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে। বুধবার সকালে লোকমুখে জানতে পারেন যে, সংশ্লিষ্ট ৩ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য ইউনুস আলীর বাড়িতে তার ছেলের হাত পা বেঁধে পেটাচ্ছে। তার নিরপরাধ ছেলেকে যারা এভাবে নির্যাতন করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তিনি।
শিশুটির মামা রাজু মিয়া বলেন, শামীমকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে ভর্তি করতে গেলে ইউনুস মেম্বারের লোকজন তাকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। চিকিৎসা না পেয়ে বাড়ি ফিরে আসে সে।
নির্যাতনের শিকার আরেক শিশু রাসেলের বাবা মন্তাজ আলী জানান, বুধবার সকালে তিনি কাজে বেরিয়ে যান। বিকেলে বাড়িতে ফিরে জানতে পারেন যে, সকালে দুটি মোটরসাইকেলে করে ৪/৫ জন লোক এসে তার ছেলেকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ইউনুস মেম্বারের বাড়িতে আটকে রেখে বেধড়ক মারধর করে। পরে পুলিশের সহায়তায় বাড়ি ফিরে আসে সে। তিনি বলেন, বাড়িতে এসে দেখি ছেলে আমার অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ঠিকভাবে সে হাঁটতে পারছে না। কেউ কথা বলতে গেলে কোনো কথা বলছে না, লোকজন দেখলেই সে আঁতকে উঠছে। পরে সন্ধ্যায় স্থানীয়দের সহায়তায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ওমর ফারুক জানান, শিশু রাসেলের দুই ঊরুতে চারটা সুঁই ফোটানো হয়েছে এবং বাম হাঁটুর নিচে ফোলা আছে। এছাড়া ডান পায়ের গোড়ালি ফুলে গেছে। তার এক্সরে করার জন্য বলা হয়েছে। তিনি বলেন, শিশুটির ওপর এটি অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ইউপি সদস্য ইউনুস আলী বলেন, আমি মারধর করিনি। আকরাম ও ইয়াকুবের বাড়িতে শিশু দুজনকে মারধর করেছে।
মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করে আকরাম হোসেনে বলেন, প্রথমে শামীমকে নিয়ে আসা হয়। পরে তার কথামতো রাসেলকে আনা হয়। তাদেরকে মেম্বারের বাড়িতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মেম্বার চুরি যাওয়া টাকা উদ্ধারের জন্য শিশু দুজনকে মারপিট করে। এ সময় তিনি ও তার ভাই শিশু দুজনকে চড়থাপ্পড় মেরেছে।
বুধবার রাতে যোগাযোগ করা হলে কাউনিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুমুর রহমান বলেন, ৯৯৯ খবর পেয়ে টেপামধুপুর ইউনিয়নের সদস্য ইউনুস আলীর বাড়ি থেকে শিশু দুটিকে উদ্ধার করে পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হয়। পরে শুনেছি শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং অপরজন বাড়িতে আছে।
এ ঘটনায় লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে ঘটনাস্থল থেকে যেহেতু শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়েছে এ ব্যাপারে থানায় একটি জিডি দায়ের করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে যোগাযোগ করা হলে রংপুর জেলা পুলিশ সুপার ফেরদৌস আলী চৌধুরী জানান, সিঁধ কেটে টাকা চুরি সন্দেহে দুই শিশুকে অমানবিক নির্যাতনের ঘটনাটি আমি জানতে পেরেছি। এ ব্যাপারে কাউনিয়া থানার ওসিকে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। তবে অভিযুক্ত ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে নির্যাতনের শিকার দুই শিশুর পরিবার থানায় অভিযোগ দায়েরে ভয় পাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, ‘তারা অভিযোগ দায়ের করলে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যাযাদি/ এস