শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

নোয়াখালী পাসপোর্ট অফিসে দালালদের দৌরাত্ম 

স্টাফ রিপোর্টার, নোয়াখালী/ সোনাইমুড়ী প্রতিনিধি
  ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০২
ফাইল ছবি

নোয়াখালী পাসপোর্ট অফিসে দালাল ছাড়া কোন কাজই হয় না। নিয়মনীতির নামে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সেবাগ্রহীতারা। ফলে বাধ্য হয়ে দালাল চক্রের হাতে জিম্মি হতে হচ্ছে পাসপোর্ট প্রত্যাশিদের। এই অফিসে দালালদের মাধ্যমে অতিরিক্ত ফি ও উৎকোচ ছাড়া মিলছে না পাসপোর্ট। এসব ঘটনা নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে বলে কয়েকজন ভুক্তভোগী জানিয়েছেন।

জানা যায়, নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালালদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট ছাড়া পাসপোর্ট করা অসাধ্য হয়ে পড়ে। প্রতিদিন গড়ে দুই শতাধিক আবেদন জমা হয়। প্রতিটি পাসপোর্টে দুই-তিন হাজার টাকা ঘুষ বাণিজ্য হয়ে থাকে। পাসপোর্ট অফিসের সামনে নোয়াখালী-ঢাকা মহাসড়কের দুই পাশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কম্পিউটারের দোকান। এইসব দোকানের আড়ালে চলে পাসপোর্টের দালালি। অনেকেই এদের খপ্পরে পড়ে অতিরিক্ত টাকা গুনছেন। আবার পাসপোর্ট অফিসের সামনে ও ভিতরে এসব দালাল চক্রের লোকজন সকাল থেকেই রাত পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে। দালাল চক্রের অনুসরণ না করলে পাসপোর্ট প্রত্যাশিকে পড়তে হয় বিপাকে। নিজের পাসপোর্ট নিজেই করতে গেলে সময়মত পাওয়া অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। প্রতিটি আবেদনে দালালের সাংকেতিক চিন্হ রয়েছে। এই চিন্হ ছাড়া কেউ গেলে নানা ভুল-ভ্রান্তির অজুহাতে হয়রানি হতে হয় সাধারণ গ্রাহকদের।দালালের সাংকেতিক চিন্হ না থাকলে জমা দিতে কাউন্টারে গেলে আবেদন ফরম ফিরিয়ে দেওয়া হয়।শুরু হয় হয়রানি। ভোগান্তিতে পড়ে অনেকেই বাধ্য হয়ে দালালদের স্বরাপন্ন হতে হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে,গত বছরের ২৬ আগষ্ট নোয়াখালী পাসপোর্ট অফিসে র্যাব ১১ অভিযান পরিচালনা করে ১৭ জন দালালকে আটক করে। একই বছরের ২০ মার্চ আরেক অভিযানে ১৪ জন দালালকে আটক করে র্যাব। তবে এর পরেও থেমে নেই দালাল চক্রের কর্মকাণ্ড।দালালদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে এই অফিসটি।

কয়েকজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করে জানান, পাসপোর্ট করার জন্য নিজে আবেদন করে নিয়ে গেলে অফিসের কর্মচারীরা নানা ভুল দেখিয়ে হয়রানি করেন। তাই ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে অনেকেই দালালির মাধ্যমে পাসপোর্ট করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এই সুযোগে প্রতিটি পাসপোর্ট বাবদ দুই থেকে তিন হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালালেরা। যার একটি নিদ্রিষ্ট অংশ পৌছে যাচ্ছে পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারীরা-কর্মকর্তাদের হাতে। পাসপোর্ট অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাড়তি আয়ের লোভে দালালদের সঙ্গে শক্ত সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। পাসপোর্টে কোন ভুলত্রুটি থাকলে অফিসের গেলে সেবা প্রত্যাশীরা পড়তে হয় মহা বিপাকে। কর্মকর্তাদের নির্দেশে অফিসের সামনে কম্পিউটার দোকানদার দালাল সেলিমের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। সে মোট অংকের টাকা চুক্তি করে অফিসের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ভুলত্রুটি পাসপোর্ট করিয়ে নেন। নাম পিতার নাম বয়স ভুল হলেই এই অফিসে টাকা গুনতে হয় ৫০ থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত।

কয়েকজন পাসপোর্ট আবেদনকারী জানান, সোনাইমুড়ী উপজেলার বাগপাচঁরা গ্রামের শফিকুর রহমান ওরফে হোডা মামু,কাঁঠালি গ্রামের আনোয়ার হোসেন,সোনাইমুড়ী বাজারের শাপলা স্টুডিওর স্বপন,ডুমুরিয়া গ্রামের খোকন ওরপে আর্মি,দেওটি বাজারের ব্যবসায়ী মনির, মতিন, বাংলাবাজার এশিয়া ব্যাংকের এজেন্ট খোকন, বজরা বাজার এশিয়া ব্যাংকের এজেন্ট মতিন, ছাতারপাইয়া বাজারের স্টুডিও ব্যবসায়ী জহির পাসপোর্টের দালালি করে থাকেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন,সোনাইমুড়ীর খাদ্য গুদাম এর বিপরীতে বদরুদ্দোজা মার্কেটে নুরুল আলম আনোয়ার নামে এক ব্যক্তি সুফিয়া এন্টারপ্রাইজ নামক প্রতিষ্ঠান দিয়ে দীর্ঘ বছর ধরে পাসপোর্টের দালালি করে আসছেন। সে পাসপোর্টের আবেদন ও পরামর্শ দেয়ার কথা বলে ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে করছে দালালি। প্রতিটি পাসপোর্টে সে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে থাকেন। ভুল ত্রুটি থাকলে মোট অংকের টাকা চুক্তি করে অফিসের মাধ্যমে কাজ করিয়ে দেন। সোনাইমুড়ী উপজেলায় পাসপোর্ট দালালের একাধিক সিন্ডিকেট রয়েছে।এইসব সিন্ডিকেট ছাড়া যেন কোন পাসপোর্ট হয় না। দালালরা এসব অর্থ দিয়ে এলাকায় গড়েছেন বিরাজ বহুল বাড়ি, কিনেছেন জমি, চলেন আলিশান ভাবে।

নোয়াখালী সদর এলাকার সোহাগ জানান, দালাল ছাড়া কোন কাজ হয়না এই অফিসে। আবেদন ফর্ম পূরণ, ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ছবি তুলতে গেলে অফিসের কর্মচারীরা দূব্যবহার করে থাকেন।আর মাইজদী শহরে অধিকাংশ কম্পিউটার দোকানে পাসপোর্ট এর আবেদন করার নামে চলে চুক্তি। তাদের সাথে চুক্তি করলেই হয়রানি ছাড়া পাসপোর্ট করা যায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোনাইমুড়ী উপজেলার এক দালাল জানান,নতুন সিস্টেমে কাজ করতে হয়। বাইরে গেট থেকে আমাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ লোকদের কাগজপত্র দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দেই। অফিসে কর্মকর্তাদের ফোন করে নাম-ঠিকানা জানিয়ে দেই। সাধারণ ই-পাসপোর্ট করতে ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা নিয়ে থাকি। এর মধ্যে ব্যাংক ড্রাফট ৪ হাজার ২৫ টাকা, অনলাইনে আবেদন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, পরিস্থিতি বুঝে পুলিশ ভেরিফিকেশনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দিতে হয়। পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের ১ হাজার টাকা দিতে হয়। আর জরুরি ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রে সাড়ে দশ হাজার নিয়ে থাকি। সেক্ষেত্রে পাসপোর্ট অফিসের কর্মাকর্তাদের একটু বেশি টাকা দিতে হয়।

নোয়াখালীর ডিএসবির এক কর্মকর্তা জানান, দালালদের সাথে রয়েছে অফিসের কর্মকর্তাদের গোপন সিন্ডিকেট। পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন করতে সেবা প্রত্যাশীদের ফোন দিতে গেলেই দেখা যায় ওই পাসপোর্টের আবেদনে দালালদের ফোন নাম্বার রয়েছে। এদের পেশাই পাসপোর্ট এর দালালি করা।

ই- পাসপোর্ট পরিচালক সাইদুর রহমান জানান, সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ থাকলে আমাদেরকে বলেন। আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। তবে পাসপোর্ট অফিসে টিএনটি ও মোবাইল নাম্বার কেন বন্ধ রয়েছে তা তিনি অবগত নন।

নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ হাফিজুর রহমানের এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে একাধিকবার সরকারি নাম্বারে ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে