কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কনকাপৈত ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, আ’লীগ নেতা মোঃ জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
মাত্র ৩০ শতাংশ কাজ করে বাকি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। ভূয়া ভাউচার তৈরীর করে বিভিন্ন প্রকল্প দেখিয়ে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এছাড়াও একই রাস্তা নামে-বেনামে সংস্কারের কথা বলে একাধিবার প্রকল্প পাশ করে বরাদ্দকৃত টাকা তছরুপের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এই নিয়ে কনকাপৈত ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার মানুষের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জাফর ইকবালের ক্ষমতাকালীন সময়ে বিএনপি জামায়াতের বহু নেতাকর্মী তার বাহিনীর হাতে মারধর ও লাঞ্চনার শিকার হয়েছেন। ২০১৬ সালে প্রথমবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী দিয়ে ইচ্ছেমতো অফিস পরিচালনা করতেন। ইউনিয়নের বিভিন্ন ওয়ার্ড সদস্যরা তার কথার বাহিরে গেলে বন্ধ রাখা হত বিভিন্ন বেতন ভাতা। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে প্রায় এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করতেন। শিক্ষক পিটানো থেকে আরাম্ভ করে কনকাপৈতে এক নায়কতন্ত্র বাস্তবায়ন করেছেন তিনি।
শুক্রবার-শনিবার ছাড়া তিনি কোনদিন অফিসে আসতেন না। তার ক্যাডার বাহিনীর অন্যতম প্রধান সাবেক ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ফরিদ ও যুবলীগ নেতা উত্তর কনকাপৈত গ্রামের ফকিরের নেতৃত্বে এসব হামলা পরিচালিত হতো। একাধিকার হামলা ও মারধরের শিকার হয়েছেন সাবেক ইউনিয়ন শিবির সভাপতি মোঃ হোসাইন, ধোড়করা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, আ’লীগ নেতা আব্দুল মান্নান, সাবেক চেয়ারম্যান প্রার্থী, যুবলীগ নেতা কাজী ইকবাল হোসেন।
এছাড়াও এলজিএসপির ৯ বছরের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ একাধিক ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছেন। কাজের উন্নয়ন শতভাগ দেখানো হলেও বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। যার কারনে এলাকাবাসীর এখনো দুর্ভোগ কাটেনি। এতে করে সরকারের গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প দলিল দস্তাবেজে বাস্তবায়ন দেখানো হলেও সুফল মেলেনি কনকাপৈত বাসীর। ২০-২১,-২১,২২,২৩,-২৪ অর্থ বছরে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে টিআর, কাবিখা, এডিপি ও নন ওয়েজ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন দেখিয়ে উত্তোলন করেছেন কোটি টাকা। এছাড়াও ৪০ দিনের কর্মসূচিতে কোন শ্রমিক না লাগিয়ে ভেকু দিয়ে মাটি কেটে পুরো এক তৃতীয়াংশ টাকা আত্মসাত করেছেন।
এই বিষয়টি নিজ এলাকায় জানা জানি হলে চেয়ারম্যান জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু হয় । এ নিয়ে রাজনীতিবীদ ও সাধারণ জনগণের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। মাত্র ৩০ শতাংশ কাজ করে চেয়ারম্যান কর্তৃক আত্মসাতের কয়েকটি প্রকল্প হলো; ২০-২১ অর্থ বছরে কাবিটা সাধারণ ২য় পর্যায় উন্নয়ন প্রকল্প হিংগুলা চানখাদিঘির পূর্ব-উত্তর কর্ণারে ১ লাখ ৮৮ আশি হাজার টাকার মাটি ভরাট করার কথা থাকলেও কাজ করেছেন মাত্র ৩০ হাজার টাকার। জাগজুর বুড়ি মলিয়ারা থেকে পন্নারা বেড়িবাঁধ পুনঃ নির্মাণে ৬ লাখ ৬৪ হাজার টাকা বরাদ্ধ হলেও শ্রমিক দিয়ে কাজ না করে বেকু দিয়ে ১ লাখ টাকার কাজ করে বাকি টাকা চেয়ারম্যান তার পকেটে ভরেন। জঙ্গলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে মাটি ভরাটের জন্য ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্ধ হলে কাজ করেছেন ২০ হাজার টাকা।
বুদ্দিন শাহিনের বাড়ির রাস্তা সিসি ঢালাই ৪ লাখ বরাদ্ধ দেওয়া হলে কাজ হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার। এই রাস্তা চেয়ারম্যান নিজে একাধিক বার দেখিয়ে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেন। বীরঙ্গনা আফিয়া খাতুনের বাড়ির রাস্তা নির্মাণে ব্যয়ে ৩ লাখ ৪ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হলেও কাজ হয়েছে মাত্র লক্ষাধিক টাকার মত। সাজুর দোকান হইতে মলিয়ারা ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তা পূূন: নির্মাণ কাজে মাটি ভরাট না করেই ১ লাখ ৯১ হাজার টাকা আত্মসাত করেন। বুদ্দিন খুরশিদের বাড়ি হতে জাকির মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা কয়েকধাপে পূণ: নির্মাণ দেখিয়ে ভুয়া ভাউচারে হাতিয়ে নেন ৬ লক্ষাধিক টাকা। এছাড়াও একই গ্রামের বুদ্দিন মহিলা মাদরাসা রাস্তা, শাহিনের বাড়ি হতে ভুট্টুর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পূণঃনির্মাণ ও বুদ্দিন মহিলা মাদরাসার মাঠ ভরাট ২৫-৩০ হাজার টাকার মাটি ভরাট করে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা বিল উত্তোলন করেন। ১৮-১৯ অর্থ বছরে পন্নারা মুন্সিবাড়ি হইতে মিয়াজী বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পূণঃ নির্মাণ ২০ হাজার টাকার মাটি ভরাট করে ২ লাখ টাকা উত্তোলন করেন।
শাহাজানপুর আবু তাহের মোল্লার বাড়ি হইতে হাজী আব্দুর কাদেরের বাড়ি, অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি ১ম পর্যায়ে কনকাপৈত ফরিদের বাড়ি রাস্তা পূণঃ নির্মাণ আনুমানিক ২০ হাজার টাকা মাটি ভরাট করে ২ লাখ টাকা উত্তোলন করেছে। বুদ্দিন পশ্চিম পাড়া সেলিমের বাড়ি সংলগ্ন রাস্তা পুন:নির্মাণ, আতাকরা ইউসুফের বাড়ি সংলগ্ন রাস্তা পুন:নির্মাণ ভেকু দিয়ে মাটি কেটে ৬ লাখ ৬৪ হাজার টাকা উত্তোলন করে।
৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শরিফ আহমেদ বলেন, ২১ সালের ২৬ ডিসেম্বরে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আমাকে ২০ মাসের বেতন দেননি চেয়ারম্যান জাফর ইকবাল। ২০২৩-,২৪ অর্থবছরে জঙ্গলপুর সড়ক থেকে মাহফুজের বাড়ির রাস্তার আর সি.সি. ঢালাই প্রকল্পের সভাপতি ছিলাম আমি। কিন্তু তিনি আমাকে না জানিয়ে এই টাকা উত্তোলন করেন। পরে আমি টাকার জন্য চাপ দিলে কোরবানের সময় দিবেন বলে আমাকে জানান। যদি টাকা না পাই তাহলে নির্বাহী অফিসারের কাছে আমি লিখিত জানাব।
৫ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান মীর হোসেন বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ঠিকমত বেতন ভাতা পায়নি। কাজের জন্য তাকে একাধিকবার অনুরোধ করার পরেও তিনি আমাকে দেননি। সেই স্বৈরাচারি কায়দায় সব সময় অফিস পরিচালনা করতেন। পরে জানলাম কোন হিসাব না দিয়ে মধুমতি ব্যাংক একাউন্ট থেকে চেয়ারম্যান প্রায় ৫ লাখ টাকা উত্তোলন করেন।
এই বিষয়ে কনকাপৈত ইউপি চেয়ারম্যান জাফর ইকবালের ব্যক্তিগত মুঠোফোনটি বর্তমানে বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। পরে তার মেসেঞ্জারে খুদেবার্তা ও ভয়েস পাঠানো হলেও তিনি সারা দেননি।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) গোলাম মাওলা বলেন, আমি ঐ সময়ে দায়িত্বে ছিলাম না। বিষয়গুলো আমি খতিয়ে দেখবো। তদন্ত স্বাপেক্ষে বিস্তারিত জানানো যাবে। চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: জামাল হোসেন বলেন, চেয়ারম্যান জাফর ইকবালের বিভিন্ন অনিয়মের তথ্যটি কেউ আমাকে জানায়নি। এইমাত্র আপনার কাছে শুনলাম। যদি কেউ লিখিত আকারে আমাদেরকে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দেয় তাহলে তার বিরুদ্ধে আমরা আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।