পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে টাঙ্গাইল জেলায় সড়ক-মহাসড়কে পশুবাহী ও বাড়তি যাত্রীচাপ সামাল দিতে পুরোনো, ফিটনেসবিহীন ও লক্কর-ঝক্কর বাস-ট্রাকগুলো রাস্তায় নামানোর মরিয়া প্রস্তুতি চলছে। গাড়ির প্রতিটি গ্যারেজে এখন রঙ, ওয়ার্কশপ ও নানা মেরামতের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকরা। বাস মালিকরা ঈদে বাড়তি আয়ের আশায় পুরোনো যানবাহনগুলোকে সাময়িকভাবে চকমকে করে তোলার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।
ঈদুল আজহায় ঘরমুখো মানুষের ঢল সামাল দিতে টাঙ্গাইল বাস টার্মিনালে প্রস্ততি শুরু হয়েছে। জোরেশোরে চলছে বাস ধোয়ামোছার কাজ। পরিষ্কার করা হচ্ছে সিট, পরীক্ষা করা হচ্ছে যন্ত্রাংশ। এক কথায় গাড়িগুলো চকচকে-ঝকঝকে করতে যা প্রয়োজন তা করা হচ্ছে।
সরেজমিনে টাঙ্গাইল শহরের রাবনা বাইপাস থেকে এলজিইডি মোড় পর্যন্ত ৮-১০টি গ্যারেজে পুরোনো গাড়ি ‘নতুন বানানোর’ মহোৎসব চলছে। এছাড়া এলেঙ্গা, মির্জাপুর, গোপালপুর, ভূঞাপুরসহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে, গ্যারেজে পড়ে থাকা বহু পুরোনো বাসে চলছে রঙের কাজ, স্টিকার লাগানো, জানালা-দরজা ঠিক করা, এমনকি ভাঙা বডিতে সামান্য ইস্পাত জোড়া লাগানো। এসব গাড়ির বেশিরভাগেরই বৈধ রুট পারমিট, ইঞ্জিন ফিটনেস সনদ কিংবা ইন্স্যুরেন্স নেই। কিন্তু ঈদের বাড়তি আয়-রোজগারের আশায় মালিকরা কৌশলে এসব বাস রাস্তায় নামানোর পরিকল্পনা করছেন।
টাঙ্গাইল শহরের গাড়ি মেরামতের একটি গ্যারেজে কাজ করা শ্রমিক আমানুল্লাহ জানান, ঈদের সময় তাদের কাজ অনেক বেড়ে যায়। একেকটা পুরোনো বাসে নতুন রঙ করে, লাইট লাগিয়ে, স্টিকার মেরে একদিনেই ‘নতুন’ বানিয়ে দিচ্ছেন তারা। মালিকরা তাড়াহুড়ো করে তাদের চাপ দিচ্ছেন- যাতে ঈদের আগেই বাসগুলো রাস্তায় নামানো যায়।
গাড়ির বডিমিস্ত্রি মো. কবির, আব্দুল মজিদ, আব্দুর রাজ্জাক জানান, বিকল বাস মালিকদের নির্দেশনায় তারা বাসগুলোকে সড়ক-মহাসড়কে চলার মতো করে মেরামত করছেন। যেমন জানালা-দরজা ঠিক করা, লাইট লাগানো, ভাঙা বডিতে সামান্য ইস্পাত জোড়া লাগানো ইত্যাদি। এরআগে ঈদুল ফিতরে তারা ২০-২৫টি বিকল বাস সড়কে নামানোর জন্য কাজ করেছেন। ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে বাসের বডিটা যাতে সুন্দর দেখা যায় মালিকরা সেভাবেই চান তারাও তাই করছেন। ফিটনেসবিহীন গাড়ির কাজও তাদের করতে হয়। না হলে অফিস থেকে ফিটনেস দেয় না। তারা সাধারণত গাড়ির মেরামত করেন।
রঙমিস্ত্রি আব্দুল বাছেদ, নুরুল ইসলাম ও রফিক হাফেজ জানান, বাসগুলো যাতে দেখতে মনোরম সুন্দর লাগে সেভাবেই তারা রঙ করছেন, স্টিকার লাগাচ্ছেন। এসব গাড়ি রাস্তায় বেরোলে রঙ ও স্টিকার দেখে যাত্রীরা নতুন ভেবে উঠে পড়বেন।
একই রকম চিত্র দেখা গেছে, এলেঙ্গা ও করটিয়ার গ্যারেজগুলোতেও। শ্রমিকরা বলছেন, মালিকরা বেশি খরচ করতে চান না- শুধু বাহ্যিক রঙচঙে চেহারা হলেই চলবে, তারাও তাই করছেন।
এসব ফিটনেসবিহীন বাসগুলোর কারণে সাধারণ যাত্রীরা ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। ঈদে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ টাঙ্গাইলে আসবে এবং এখান থেকে রাজধানী ঢাকা, উত্তরবঙ্গ ও ময়মনসিংহসহ আশপাশের জেলায় যাবে। এসব রুটে যদি ফিটনেসবিহীন বাস চলে তাহলে যে কোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। যমুনা সেতু-ঢাকা মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রী সাধারণের সঙ্গে কথা আলোচনাকালে তারা জানায়- রঙ দিয়ে নিরাপত্তা কেনা যায় না। ফিটনেস বিহীন গাড়ি সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করলে নিরাপত্তার ঝুঁকি থেকে যায়।
এ রুটের বাসযাত্রী মো. জাকির হোসেন, আলতাব মাহমুদ, রাকিবুল হাসান, কলেজছাত্র মাইদুল, শিশির, নাজমুল সহ অনেকেই জানান, ঈদযাত্রায় অনেক সময় দাঁড়িয়ে থেকেও ভালো বাস পাওয়া যায় না। তখন বাধ্য হয়ে এসব পুরোনো বাসেই উঠতে হয়। কিন্তু বাসের জানালা-দরজা বন্ধ হয় না- চলতি পথে চালকরা ব্রেক ঠিকমতো ধরে না ফলে প্রাণ নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হয়।
টাঙ্গাইলের সাবেক শিক্ষক মতিউর রহমান ও আজমত আলী জানান, প্রতি ঈদেই সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল দেখা যায়। প্রশাসন যদি আগেই এসব ফিটনেসবিহীন বাসকে আটকায় তাহলে অনেক প্রাণ রক্ষা পেতে পারে।
এদিকে টাঙ্গাইল জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির এক সদস্য জানান, যাত্রী চাহিদা পূরণে কিছু পুরোনো গাড়ি সাময়িক মেরামত করে রাস্তায় নামাতে হয়। তবে তারা কোনো বাস খুব খারাপ অবস্থায় যাতে না থাকে সেই চেষ্টা করেন।
টাঙ্গাইল জেলা নিরাপদ সড়ক চাই(নিসচা) এর সভাপতি ফিরোজ আহমেদ বাচ্চু জানান, ‘একটি সড়ক দুর্ঘটনা- সারা জীবনের কান্না’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে তারা নিরাপদ সড়কের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত প্রাণহানির ঘটনায় তারা শঙ্কিত। শুধুমাত্র ঈদ মৌসুমে অধিক লাভের আশায় ফিটনেসবিহীন বাস রাস্তায় নামানো সম্পূর্ণ অনৈতিক ও বেআইনি। ঈদের আগেই এ বিষয়ে সরকার ও প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। তিনি জানান, ঈদুল ফিতরেও তারা ট্রাফিক পুলিশ ও বিআরটিএ’র সঙ্গে সড়ক-মহাসড়কে দায়িত্ব পালন করেছেন। ঈদুল আজহায়ও তারা পুরো টিম নিয়ে সড়ক নিরাপত্তায় মাঠে থাকবেন।
টাঙ্গাইল জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সাবেক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শফিক জানান, তাদের সমিতিভুক্ত প্রায় ৮০০ গাড়ি রয়েছে। তারা সাধারণত ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়ক-মহাসড়কে নামান না। সমিতির অধিকাংশ গাড়িরই ফিটনেস রয়েছে। সর্বোচ্চ দেড়শ’ থেকে দুইশ’ গাড়ির ফিটনেস না থাকতে পারে। সড়কে চলতে চলতে যেসব গাড়ি বিকল হয় বা দুর্ঘটনায় পতিত হয় অথবা ফিটনেসের অনুপোযুক্ত হয়- সেগুলো তারা রাস্তায় নামতে দেন না।
টাঙ্গাইল জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি ইকবাল হোসেন জানান, টাঙ্গাইলের ৯৮ শতাংশ গাড়ির ফিটনেস রয়েছে- বাকি ২ শতাংশ নেই। তবে তিনি তাদেরও নিরুৎসাহিত করে থাকেন। ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে চালানোর কোনো সুযোগ নেই বলেও জানান তিনি।
বিআরটিএ টাঙ্গাইল অঞ্চলের সহকারী পরিচালক(ইঞ্জি:) শেখ মাহতাব উদ্দিন আহমেদ জানান, তারা নিয়মিত প্রতি সপ্তায় দুইদিন সড়ক-মহাসড়কে অভিযান চালান। সর্বশেষ চারটি অভিযানে ২৪টি যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং ৫৩ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। কিন্তু ঈদের সময় সব রুটে একসঙ্গে নজরদারি করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় বাসগুলো শহরের বাইরে রাখা হয় এবং সেখান থেকেই যাত্রী তোলা হয়, ফলে সেগুলো ধরা পড়ে না।
তিনি জানান, এবারের ঈদুল আজহায় তারা প্রতিদিন নিয়মিত অভিযান পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছেন। তাছাড়া লক্কর-ঝক্কর মার্কা ফিটনেস বিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।