বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন ২০২৫, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কামারপাড়ায় পুড়ছে কয়লা, জ্বলছে লোহা; নেই শুধু ক্রেতা

শায়েস্তাগঞ্জ (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি
  ০৩ জুন ২০২৫, ১৭:২৪
কামারপাড়ায় পুড়ছে কয়লা, জ্বলছে লোহা; নেই শুধু ক্রেতা
ছবি: যায়যায়দিন

ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে টুং টাং শব্দে ব্যস্ত সময় পার করছেন হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার কামাররা। চলছে হাঁপর টানা, পুড়ছে কয়লা, জ্বলছে লোহা। হাতুড়ি পিটিয়ে কামাররা তৈরি করছেন দা, বটি, ছুরিসহ মাংস কাটার বিভিন্ন সরঞ্জাম। বর্তমানে বিক্রি-বাট্টা নেই।

তবে সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করলেও তাদের মুখে নেই কোনো উচ্ছ্বাস, নেই প্রাণ ভরা হাসি। তারপরও আসন্ন কোরবানির ঈদের কথা মাথায় রেখে নতুন আশায় বুক বেঁধে ব্যস্ত সময় পার করছেন কামারশিল্পীরা।

1

হাতুড়ি আর লোহার টুং টাং শব্দে মুখরিত এখন কামার পাড়াগুলো। ঈদের দিন পর্যন্ত চলবে এমন ব্যস্ততা।

কামাররা জানান, কয়লা ও লোহাসহ সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো লাভ হয় না তাদের। তবু পূর্বপুরুষের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করছেন কামাররা।

প্রতিবছর কোরবানির ঈদে তাদের বানানো ধারালো জিনিসপত্রের কেনা-বেচা বেড়ে যায়। এ থেকে অর্জিত টাকায় সারা বছরের খোরাক জোগাড় হয়। আর বছরের বেশিরভাগ সময় কামার শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা একপ্রকার বেকার সময় কাটান।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাপাতি, দা, বটি, ছুরি তৈরি এবং পুরোনো জিনিসে শান দিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কামাররা। দম ফেলার ফুরসৎ নেই তাদের।

ঈদ উপলক্ষে লোহার বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কামারশিল্পীরা। গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করছেন সবাই।

কামারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছরই কোরবানির ঈদে দা, বটি, ছুরি, চাপাতিসহ লোহার বিভিন্ন জিনিসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এ মৌসুমকে ঘিরে ভালো আয়-উপার্জন করে থাকেন তারা। তবে এবার হতাশা ঘিরে ধরেছে তাদের। একেবারেই বেচা-কেনা নেই বলা চলে।

বর্তমানে বেচা-কেনা কেমন চলছে জানতে চাইলে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণডুরা সড়ক বাজারের প্রভাস কর্মকার নামের এক কামার আক্ষেপের সুরে বলেন, খদ্দেরই নেই, তার আবার বেচা-কেনা!

আর কিছুদিন পর ঈদ। অন্যবার এমন সময়ে জমে ওঠে দা-বটির বাজার, অথচ এবার বিক্রিই নেই। ক্রেতারা আসছেই না। সারাদিনে দুই-তিনটা দা-বটিও বিক্রি হয় না।

কামার শিল্পীরা বলেন, বছরের এই ঈদ মৌসুমটাই আমাদের মূল লক্ষ্য থাকে। বছরের কয়েকটা দিন ভালো টাকা উপার্জন করার চিন্তা করলে এই দিনগুলোকে ঘিরেই করা হয়। গত ঈদে কয়েক হাজার টাকা উপার্জন হলেও কারিগরদের বেতন দিয়ে খুব একটা থাকেনি। ভেবেছিলাম কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে বেশি অর্ডার আসবে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন একেবারেই ভিন্ন।

এখন তাদের আশা ঈদ এগিয়ে আসতে আসতে যদি বিক্রি কিছুটা বাড়ে। সেই লক্ষ্যে থেমে না থেকে একের পর এক জিনিসপত্র তৈরি করে চলেছেন তারা।

বর্তমানে প্রতিটি দা তৈরিতে প্রকারভেদে মজুরি নেওয়া হচ্ছে ২৫০-৬০০ টাকা পর্যন্ত। চাকু তৈরিতে নেওয়া হচ্ছে ১২০ টাকা। বড় ছুরি তৈরিতে নেওয়া হচ্ছে ৫০০-৭০০ টাকা। বটি তৈরিতে নেওয়া হচ্ছে ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা।

শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার কাজিরগাঁও গ্রামের নেপাল দেব ও জন্টু দেব সুতাং শাহজীবাজারে দা, বটি নিয়ে এসেছিলেন। তারা জানান, সুতাং বাজারে উন্মুক্ত খোলা আকাশের নিচে কখনও রোদ, কখনও বৃষ্টিতে ভিজেই তাদের দোকানদারি করতে হয়। বাজারে মোটামুটি বেচাবিক্রি হচ্ছে।

কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন উপজেলার স্থানীয় কামাররা। কোরবানির পশু জবাই ও মাংস কাটার জন্য তৈরি করা হচ্ছে ছুরি, চাপাতি, দা, বঁটিসহ নানাবিধ সরঞ্জাম। তবে এসব সরঞ্জাম তৈরি করলেও দেখা নেই ক্রেতার।

এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পশু কোরবানি ও মাংস কাটার সরঞ্জাম তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কামাররা। অনেকেই পশু কোরবানির জন্য নতুন করে দা, ছুরি, চাপাতি তৈরি করছেন। কেউ কেউ পুরনো সরঞ্জামে শান বা লবণ-পানি দেওয়ার কাজ করছেন।

ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখনো পুরোদমে বিক্রি শুরু হয়নি। আগে মানুষ গরু কিনবে পরে ছুরি-চাপাতিসহ অন্যান্য সরঞ্জাম কিনবে। কবে থেকে পুরোদমে বেচাকেনা হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তারা জানান, ঈদের ২-৩দিন আগে থেকে পুরোদমে বেচাকেনা শুরু হবে বলে তারা আশাবাদী। তবে এবছর অন্যান্য বছরের চেয়ে বেচাকেনা ভালো হবে না বলেন তারা।

ঈদের বেচাকেনা এখনো শুরু হয়নি। আরও পরে শুরু হবে। তবে এখন বানিয়ে রাখছেন, পরে শুধু বিক্রি করবেন। সারা বছর কাজ না থাকলেও কোরবানির ঈদের এ সময়টা বারবারই ব্যস্ত থাকতে হয় তামাদের।

কামাররা বলছেন, এ পেশায় অধিক শ্রম, জীবিকা নির্বাহে কষ্ট হলেও শুধু বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখতে এ পেশাটিকে এখনও আঁকড়ে ধরে আছেন। বিভিন্ন সময় এসবের চাহিদা কম থাকলেও কোরবানির পশুর জন্য বেশি প্রয়োজন হওয়ায় সকলেই আমরা ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। এই ঈদ মৌসুম ছাড়াও সারা বছর কাস্তে, কুড়ালও তৈরি করে সময় কাটে সুকুমার চন্দ্র দেব কর্মকার বলেন, এই বছর তা দেখা যাচ্ছে না।

কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে এখন একটু কাজ হচ্ছে। তবে কয়লা আর কাঁচামাল আনতে পারিনি। ঈদের আগে যদি ঠিকমতো কাজ করতে পারি তা হলে অন্তত কয়েকটা দিন একটু ভালো ভাবে চলতে পারবেন।

বর্তমানে বেচা-কেনা কেমন চলছে জানতে চাইলে রাখাল দেব কর্মকার বলেন, কয়লা ও লোহাসহ সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো লাভ হয় না। খদ্দেরই নেই, আবার আগের মতো বেচাকেনাও নেই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে